Sundar Pichai, গুগলের নতুন কর্ণধার

টিউন বিভাগ গুগল
প্রকাশিত

সুন্দর পিচাই, পুরো নাম Pichai Sundararajanor। প্রায় অপরিচিত, সাদাসিধে ও স্বল্পভাষী মানুষ। খুব বেশি লাইম লাইটে কখনোই আসেন নাই যিনি। অথচ এই মানুষটাই এখন গুগলের মতো টেক-জায়ান্টের কর্ণধার। আজকের বিশ্বের টেকনোলজি সেক্টরে সবথেকে প্রেস্টিজিয়াস জবগুলার একটা হচ্ছে গুগল। এখানে যারা কাজ করে তারা সবাই অসম্ভব মেধাবী। সুন্দর পিচাই তাদের মধ্যেই একজন। তিনি গুগলে যোগদান করেন ২০০৪ সালে। নিয়োগের মাত্র এগারো-বারো বছরে মাথায় সবাইকে পিছনে ফেলে কোম্পানীর শীর্ষপদ অধিষ্ঠিত হওয়া খুবই চমকপ্রদ একটা ঘটনা। রীতিমতো গল্পের মতো লাগে শুনতে।

Sundar Pichai New CEO of Google
Sundar Pichai New CEO of Google

 

জন্ম ১৯৭২ সালে ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের রাজধানী চেন্নাই শহরে। এই শহরেই কেটেছে তার ছোটবেলা। দুই ভাইয়ের মাঝে সুন্দর ছিলেন বড়।তাদের জন্মের আগে তাদের মা স্টেনোগ্রাফারের কাজ করতেন। বাবা রঘুনাথ ছিলেন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ার। তিনি একটা ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশের কারখানার দায়িত্বে ছিলেন। রঘুনাথের ভাষায়, "আমি প্রতিদিন বাসায় ফিরে সুন্দরের সাথে সারাদিনের কাজকর্ম নিয়ে আলাপ করতাম, কাজ করতে গিয়ে কি কি সমস্যাতে পড়তে হতো সেটাও ওকে বলতাম। ছোটবেলা থেকেই ও আমার কাজের প্রতি খুব আগ্রহী ছিলো। আমার মনে হয় এটাই ওকে টেকনোলজি সম্পর্কে আরো বেশি উৎসাহী করে তুলেছিল।"

সুন্দররা মাত্র দুইকামরার একটি ছোট্ট বাড়িতে বাস করত। দুইভাই ঘুমাতো লিভিং রুমে। তাদের ছিলো টানাটানির সংসার। বাসাতে টিভি বা গাড়ি কিছুই ছিলো না। যাতায়াত করতে হতো বাসে বা তার বাবার নীল ল্যাম্ব্রেটা স্কুটারে। অনেকসময় স্কুটারে পরিবারের সবাই ঠাসাঠাসি করে বসে যাওয়া আসা করতো। রঘুনাথ স্কুটার চালাতেন, সুন্দর সামনের জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে থাকতো আর ছোট ভাইকে নিয়ে মা বসতেন পিছনে।

Sundar with his Mom and Dad
Sundar with his Mom and Dad

অসাধারন স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন সুন্দর পিচাই। ১২ বছর বয়সে প্রথম টেলিফোন হাতে পান তিনি। যেকোন নাম্বার একবার ডায়াল করলেই সেটা মনে রাখতে পারতেন। নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে একবার তিনি বলেছেন, "মাঝে মাঝে আমার আঙ্কেল ফোন করে বলতেন, 'আমি অমুকের ফোন নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু কিন্তু তোমাকে দিয়ে একবার আমি নাম্বারটা ডায়াল করিয়েছিলাম। নাম্বারটা কি তোমার মনে আছে?' এবং প্রতিবারই আমি নাম্বারটা ঠিকঠাক ভাবে বলে দিতে পারতাম। " যদিও তিনি নিশ্চিত না এইরকম স্মৃতিশক্তি আদৌ কাজে লাগে কিনা।

গুগলের এক্সিকিউটিভরা এখনো পিচাই এর নাম্বার মনে রাখার ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হন। গুগলে ভাইস প্রেসিডেন্ট ফর ইঞ্জিনীয়ারিং Alan Eustace বলেন, "কয়েকদিন আগের একটা মিটিং এ পিচাই "ভয়েস অ্যাক্টিভেটের সার্চ" সংক্রান্ত কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। "ভয়েস অ্যাক্টিভেটেড সার্চ", এইটা আমার ফিল্ড, পিচাই এর না, কিন্তু আমারই এই পরিসংখ্যান গুলা মনে ছিলো না কিন্তু পিচাই ঠিকই মনে রেখেছে।"

সুন্দরের স্কুল ছিলো চেন্নাই শহরে। স্কুলের ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন ছিলো সে এবং তাদের টিম আঞ্চলিক পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হযেছিলো। আন্ডারগ্রাডুয়েশন করেছেন ভারতের খড়গপুর আইআইটি থেকে মেটালারজিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং (Metallurgical Engineering) এ। পড়াশুনাতে বরাবরই মেধাবী ছিলেন। আইআইটি এর সিলভার মেডালিস্ট। আইআইটি এর কোন এক শিক্ষকের মতে, উনি ছিলেন উনার ব্যাচের সবথেকে মেধাবী ছাত্র।

Pichai at the Stanford University dorms in 1994
Pichai at the Stanford University dorms in 1994

গ্রাজুয়েশনের পরে তিনি ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স ও সেমিকন্ডাকটর ফিজিক্স নিয়ে মাস্টার্স এর জন্য ফান্ডিং পান স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু প্লেন ভাড়া ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক খরচই তাদের পরিবারের জন্য অনেক কষ্ট সাপেক্ষ হয়ে যায়। তাই তার বাবা লোন নেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। পরে ফ্যামিলি সেভিংস ভেঙ্গে সুন্দরকে ১০০০ ডলার দেন তিনি। উল্লেখ্য, তখন রঘুনাথের (সুন্দরের বাবা) বার্ষিক আয় ১০০০ ডলারের থেকে কম ছিলো। পিচাই এর ভাষায় " আমার বাবা-মা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং তাদের সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ খরচ করেছেন আমার উচ্চশিক্ষার জন্য।"

মাস্টার্স করার জন্য আমেরিকাতে যান ১৯৯৩ সালে। প্রথম বছরটা উনি পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকতেন। এইসময়টাতে  বেশ কষ্টেই কেটেছে তার, ফ্যামিলিকে খুব বেশি মিস করতেন, মিস করতেন গার্লফ্রেন্ড অঞ্জলীকেও। অঞ্জলী অবশ্য কিছুদিন পরে আমেরিকাতে যান এবং পরে তাদের বিয়ে হয়। এখন তিনি সুন্দরের স্ত্রী। উনাদের একছেলে ও এক মেয়ে আছে।

Sundar Pichai and Anjali
Sundar Pichai and Anjali

আমেরিকাতে প্রথম দিকে তাকে অনেক অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। প্রথম দিকে একটা ব্যাগপ্যাক কিনতে গিয়ে তিনি খুব অবাক হন যে নতুন একটা ব্যাগপ্যাকের দাম ৬০ ডলার। ৬০ ডলার দিয়ে ব্যাগ কেনা তখন তার কাছে রীতিমতো বিলাসিতা। পরে উনি অনলাইনে কম দামে সেকেন্ড হ্যান্ড একটা ব্যাগপ্যাক কিনেন।

মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি করার এবং অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার বেছে নেওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু মাস্টার্সেই ড্রপ আউট হয়ে যান তিনি। তখন Applied Materials এ সেমিকন্ডাক্টর মেকার হিসাবে কাজ করেন। পরে ২০০২ সালে এমবিএ করেন Wharton School থেকে। এরপর ২০০৪ সাল পর্যন্ত McKinsey এ জব করেন করেন।

গুগলে যোগদান করেন ১লা এপ্রিল ২০০৪ সালে। ঐদিনই গুগল জিমেইল লঞ্চ করে। যেহেতু তারিখটা ছিলো ১লা এপ্রিল, অর্থাৎ এপ্রিল ফুল ডে, তাই উনি মনে করেছিলেন জিমেইল নামক গুগলের ফ্রি মেইল সার্ভিস বলে আসলেই কিছু নাই।এটা জাস্ট গুগলের একটা এপ্রিল ফুল প্রাঙ্ক।

Sundar Pichai New CEO Google
Sundar Pichai New CEO Google

পিচাই গুগলে যোগদান করেন একটা ছোট টিমের সাথে, টিমটা তখন গুগুল টুলবার নিয়ে কাজ করছিলো। গুগল টুলবার হলো একটা ব্রাউজার (ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার, মজিলা ফায়ারফক্স ইত্যাদি, তখনো ক্রোম আসে নাই) এক্সটেনশন, যেটা দিয়ে খুব সহজে গুগলে সার্চ করা জাবে। ঐসময় গুগলে সার্চ করতে গেলে গুগল এর হোমপেজে ঢুকে তারপরে সার্চ করতে হতো। মাইক্রোসফট আর গুগলের মধ্যে তখন বাজার দখলের প্রতিযোগীতা। গুগল টুলবার সব ব্রাউজার দিয়ে খুব সহজেই গুগলে সার্চ দেওয়া যাবে। অর্থ্যাৎ গুগলের মার্কেট শেয়ার বেড়ে যাবে। প্রতিযোগী কোম্পানি হিসাবে মাইক্রোসফট সেটা খুব সহজে মেনে নিবে না। তাই উনার ভয় ছিলো যে মাইক্রোসফট ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের পরবর্তী ভার্সনগুলাকে এমন ভাবে আপগ্রেড করবে যেটাতে ইউজাররা সহজে গুগল টুলবার ইন্সটল করতে পারবে না। তাহলে পুরা গুগল টুলবার প্রোজেক্টাই বৃথা যাবে।

Google Toolbar
Google Toolbar

তখন তিনি গুগলের নিজের একটা ব্রাউজার বানানোর প্রস্তাব করেন, যেটা দিয়ে সরাসরি গুগলে সার্চ করা যাবে। অনেক জল্পনা কল্পনার পরে গুগলের হর্তাকর্তা সবাই একমত হয় এই ব্রাউজার বানানোর ব্যাপারে, এবং তাকে ব্রাউজারটা বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঐ ব্রাউজারটাকেই এখন আমরা গুগল ক্রোম নামে চিনি। আপনি নিজেও হয়তো ঐ ব্রাউজার দিয়েই এই লেখাটা পড়ছেন।  W3Counter এর ওয়েবসাইট অনুযায়ী ক্রোম ওয়েব ব্রাউজিং জগতের ৪৬.২% দখল করে আছে। আর ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার, ফায়ারফক্স, সাফারি আর অপেরা সবাই মিলে প্রায় এর সমান।

Web Browser Market Share
Web Browser Market Share

আচ্ছা আপনি কি ক্রোম অপারেটিং সিস্টেমের নাম শুনেছেন। এইটা মুলত ল্যাপটপের অপারেটিং সিস্টেম। এই অপারেটিং সিস্টেমের ল্যাপটপগুলার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ফিচার হলো ল্যাপটপে কোন হার্ডডিক্স থাকে না এবং সব ডাটা সেভ হয় সরাসরি ক্লাউড স্টোরেজে। ২০১১ সালে প্রথম ক্রোমবুক বাজারে আসে। উল্লেখ্য, ক্রোম অপারেটিং সিস্টেমে যে ল্যাপটপগুলাকে চলে তাদেরকে সংক্ষেপে ক্রোমবুক বলে। NPD গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী এখন বাজারের কমার্সিয়াল ল্যাপটপের ২১% ক্রোমবুক। এমন কি ক্রোম অপারেটিং সিস্টেম উন্নয়নেও সুন্দর পিচাই এর ভূমিকা অসামান্য।

ChromeBook
ChromeBook

এবার আসি অ্যান্ড্রয়েডের ব্যপারে। অ্যান্ড্রয়েড মুলত Andy Rubin এর তৈরী। পরে গুগল এই মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমটাকে কিনে নেয় এবং Andy Rubin কেই অ্যান্ড্রয়েড প্রোজেক্টের প্রধান করে রাখে। কিন্তু ২০১৩ সালের প্রথম দিকে ল্যারি পেইজ রুবিনকে বলে আন্ড্রয়েডকে বাকি গুগলের প্রোডাক্টের সাথে ইন্টিগ্রেট করার জন্য। রুবিন প্রথমে রাজি হলেও পরে বেকে বসেন এবং অ্যান্ড্রয়েড প্রজেক্ট থেকে রিজাইন করেন। তারপর তার স্থলাভিষিক্ত হন সুন্দর পিচাই। আর আজকের স্মার্টফোনের বাজারের প্রায় ৮০% অ্যান্ড্রয়েডের দখলে।IDC: Smartphone OS Market Share 2015, 2014, 2013, and 2012 Chartতার এতবড় সাফল্যের পিছনে কারন হিসাবে তার অনেক সহকর্মী বলেছেন যে, উনি অনেক কঠিন কিছু প্রোজেক্টে খুব ভালো কাজ দেখিয়েছেন। উনি উনার গ্রুপ খুব ভালোভাবে রিক্রুট, মেন্টর করেছেন। উনার গ্রুপটা গুগলের গ্রুপগুলার মধ্যে বেস্ট অফ দ্য বেস্ট হিসাবে গন্য করা হয়। এছাড়া উনি দলবাজি, রাজনীতি করতেন না। সব বড় প্রতিষ্ঠানের মতোই গুগলেও পলিটিক্স আছে। সুন্দর এইগুলাকে খুব সন্তর্পনে এডিয়ে যান বলে তার শত্রু নেই বললেই চলে।

লেখা অনেক বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে, তাই আপাতত এখানেই থামি। কারো আরো বেশি জানার ইচ্ছা হলে নিচের তথ্যসুত্রগুলোতে ঢু মারতে পারেন।

একটা কথা দিয়ে শেষ করি, পৃথিবীর বেশিরভাগ বড় বড় টেক জায়ান্ট গুলার একেবারে উপরদিকে অনেক ভারতীয়দের খুজে পাওয়া যায় যেমন, মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যাডব ইত্যাদি। তারা সেসব জায়গাতে নিজের যোগ্যতায় গিয়েছে। আমাদের বাংলাদেশীদের এইসব বড় বড় জায়গাতে উপস্থিতি নাই বললেই চলে। আশা করি আমাদের মধ্যেও অনেকেই ধীরে ধীরে এইরকম কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করবে বা এই কোম্পানীগুলার টপ ম্যানেজমেন্ট লেভেলে চলে যাবে। সেদিন তাকে নিয়ে আরো এর থেকেও অনেক বড় আর্টিকেল লিখবো।

***পুনশ্চঃ কোন রকম ভুলত্রুটি চোখে পড়লে ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইল।***

 

তথ্যসুত্রঃ

১। Bloomberg Magazine

২। Fortune Magazine

৩। Quora

৪। NBCNews

৫। IDC

৬। BBC

৭। The Guardian

Level 0

আমি তন্ময়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 11 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 4 টি টিউন ও 15 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

সত্যি অশাধারন এক ব্যাক্তি