বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্যেঃ উইকিপিডিয়ায় আপনাকে প্রয়োজন!

ক্রমবর্ধমান তথ্যপ্রযুক্তির এই বিশ্বে ইন্টারনেট আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে যেখানে মানুষ তথ্যের জন্য মাত্র কয়েক ক্লিক দূরের ওয়েবের দারস্থ হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওয়েব সার্চের ফলাফল আপনাকে উইকিপিডিয়ার লিংকে নিয়ে যাচ্ছে; তাই এটি একটি দুঃখের বিষয় যদি আপনার অনুসন্ধানকৃত তথ্যটি উইকিপিডিয়ার পৃষ্ঠায় না পাওয়া যায়, অথবা যদি এটি ভুল ও দুর্বলভাবে উপস্থাপন করা হয় - এতে আপনি হতাশ বা মন:ক্ষুণ্ণও হতে পারেন।

উইকিপিডিয়া, যদিও অধিকাংশ লোকই জানেন, এটি একটি উন্মুক্ত অনলাইন বিশ্বকোষ যা বর্তমানে ২৯১টি ভাষায় চালু রয়েছে - এবং এটি এমন একটি বিশ্বকোষ যা আপনার এই মহুর্তে মনে পড়ছে এরকম প্রায় সব বিষয়ই কাভার করেছে। উইকিপিডিয়া, বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিশ্বকোষ যার মুখ্য উদ্দেশ্য হল, মানুষকে এমন একটি গ্রহ উপহার দেওয়া যেখানে সমস্ত জ্ঞান সব মানুষ তাদের নিজস্ব ভষায় শেয়ার করতে পারবেন এবং যেখানে সব মানুষের থাকবে সমান প্রবেশাধিকার।

২০০১ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকেই উইকিপিডিয়ার ওয়েব ট্রাফিক ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আজকাল এটি সাড়া বিশ্বে ইন্টারনেটের জনপ্রিয় সাইটগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে। জুলাই ২০১৫-এর পরিসংখ্যান অনুসারে উইকিপিডিয়া প্রতি সেকেন্ড দেখা হয় সাড়ে ৬ হাজার বার (মাসে ১৬,৮২৫ মিলিয়ন বার) এবং প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ইউনিক ভিজিটর প্রতি মাসে যে ট্রাফিক তৈরি করে তা মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটারের চেয়েও বেশি।

যদিও বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য নিয়ে এটি জ্ঞানের এক অমুল্য ভান্ডার তথাপি উইকিপিডিয়া লেখা এখনো শেষ হয়নি - এটি প্রক্রিয়াধীন দৈতাকার একটি কর্মযজ্ঞ। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন - যদিও ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে একাই বিভিন্ন বিষয়ের উপর ৪.৯ মিলিয়ন আর্টিকেল রয়েছে, এখনও দীর্ঘ পথ বাকী! আপনি কি দেখেছেন উইকিপিডিয়ার গোল লগোটির উপরের অংশটি অসম্পূর্ণ? এই হোলটি ওখানে ইচ্ছে করেই রাখা হয়েছে কারণ উইকিপিডিয়া সম্পূর্ণ নয়। এখানে আমার ব্যক্তিগত মতামত হল লগোটি এমনি থাকবে এবং উইকিপিডিয়া লেখা কখনোই শেষ হবে না, এটি কেবল শুরু হয়েছে। মানুষের জ্ঞানের কোন শেষ নেই। তবে হ্যাঁ, ভালো জিনিস তৈরি করতে কখনো কখনো সময় লাগে, ইভেন রোমও একদিনে তৈরি হয়নি। Alexa-এর তথ্যানুসারে বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার দিক থেকে উইকিপিডিয়ার অবস্থান ১১তম। সুতরাং বাংলাদেশের ৪৮.৩৪৭ মিলিয়ন (জুন, ২০১৫) ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অধিকাংশ ব্যবহারকারীই উইকিপিডিয়া ব্যবহার করেন।

গড়ে প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৫-৪০ মিলিয়ন বার উইকিপিডিয়া ভিজিট করা হয়। প্রতি মাসে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে উইকিপিডিয়া ব্যবহার করেন, ও কয়েক মিলিয়ন লোক সাইট ভিজিট করেন; এসব সত্ত্বেও বিশ্বকোষে বাংলাদেশ রিলেটেড টপিকস’ আন্ডার রিপ্রেজেন্টেড কারন খুব কম সংখ্যক ভিজিটরই উইকিপিডিয়া থেকে যা পান তার প্রতিদান দেওয়ার (কন্ট্রিবিউট) চেষ্ঠা করেন। প্রতিমাসে ইংরেজি উইকিপিডিয়ার ৩.১ মিলিয়ন মোট সম্পাদনার সর্বোচ্চ ১০ হাজার বাংলাদেশে থেকে করা হয়। অথচ ইউরোপিয়ান অনেক দেশেই ৫/৬ মিলিয়ন ইন্টারনেট থাকা সত্ত্বেও আমাদের প্রায় কাছাকাছি, তাদের মধ্যে সার্বিয়া, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, বুলগেরিয়া ও ডেনমার্ক উল্লেখযোগ্য।

এরপরও উইকিপিডিয়াতে বাংলাদেশ বিষয়ক অসংখ্য তথ্য রয়েছে, যা প্রয়োজন তা হল - ভালো কোয়ালিটি ও ভালো রচনাশৈলীর আর্টিকেল তৈরি করা। নিসন্দেহেই উইকিপিডিয়ায় বাংলাদেশি কন্ট্রিবিউটরের অভাব রয়েছে, এই গ্যাপ দূর করার জন্য আমাদের আরো অনেকের অনলাইন এই বিশ্বকোষের সাথে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। উইকিপিডিয়াতে ২০ হাজারের কাছাকাছি বাংলাদেশ রিলেটেড টপিক রয়েছে তারমধ্যে ৫০-এরও কম ভালো কোয়ালিটির; অধিকাংশই খুব ছোট আর্টিকেল, দুর্বল লেখনী বা অনির্ভরযোগ্য উৎস ব্যবহার করা হয়েছে বা ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। এবং যেহেতু ইংরেজিতেই ওয়েবে আমরা বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করি, তাই দুঃখের বিষয় আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাটিও উইকিপিডিয়াতে আন্ডার রিপ্রেজেন্টেড। উইকিপিডিয়ার মোট ৪.৯ মিলিয়ন আর্টিকেলের মধ্যে আমাদের বাংলা উইকিপিডিয়ায় রয়েছে মাত্র ৩৭ হাজারের কাছাকাছি। এছাড়াও, বাংলাদেশের উইকিপিডিয়া ট্রাফিকের বেশিরভাগই ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে জেনারেট হয়। আর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোর থেকে যেহেতু উন্নয়নশীল দেশসমূহে লোকজন ইন্টারনেট এক্সেস কম পায় তাই দেখা যায় উইকিপিডিয়ার তৈরিকৃত আর্টিকেলের ৮৫%ই উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিষয়সমূহ কাভার করেছে। সেহেতু প্রাকৃতিকভাবেই সমস্যার উদ্ভব হয় এবং বাংলাদেশ রিলেটেড টপিকস আন্ডার রিপ্রেজেন্টই থেকে যায় বা যা ইতিমধ্যেই কাভার করা হয়েছে সেগুলো কোন একটি অ্যাঙ্গেল থেকে লেখা হয়েছে। যদিও উইকিপিডিয়া নিরপেক্ষতার ভিত্তির উপরই দাড়িয়ে আছে কিন্তু কন্ট্রিবিউটর কম হওয়াতে আমাদের দেশ রিলেটেড সব বিষয় কাভার বা সংশোধন করা যাচ্ছে না।

এছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় উইকিপিডিয়াতে ভারতের আর্টিকেলগুলো বেশ উন্নত ও বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। যদিও ভারতে খুব বেশি একটিভ উইকিপিডিয়া কন্ট্রিবিউটর নেই তারপরও গত কয়েক বছর ধরেই ভারত থেকে অনেক কন্ট্রিবিউটর উইকিপিডিয়াতে অবদান রাখছেন এবং আস্তে আস্তে উইকিপিডিয়া প্রভাব ফেলছে। এটিও তাদের ইস্যুগুলো উইকিপিডিয়ার কভারেজ পেতে সহয়তা করছে। এছাড়াও সমস্যার সৃষ্টি হয় বিতর্কিত বিষয়সমূহ বা যখন কোন বিষয়ের উপর মিউচ্যুয়াল ইন্টারেস্ট থাকে। যেমন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান তিন দেশেরই ইন্টারেস্ট রয়েছে। দুই দেশেরই কন্ট্রিবিউটর বেশি হওয়ায়  মাঝে মাঝেই এধরণের আরো অনেক বিষয় যেগুলো বিভিন্ন সময় বায়াস্ডভাবে ইডিট করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ থেকে কন্ট্রিবিউটর কম হওয়াতে মুক্তিযুদ্ধের অনেক বিষয়েই ভুল তথ্য থেকে যায় বা বিষয়গুলোকে অন্যভাবে উপস্থাপন করা হয়। একটা ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের কোন মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধের কোন ইতিহাস নিয়ে লিখবে তখন তার লেখা এবং পাকিস্তানের একজন লিখলে তার লেখা যে এক হবে না এটাই স্বাভাবিক। এটা কিন্তু উইকিপিডিয়ার দোষ নয় - আমরা বাংলাদেশিরাই সাড়া বিশ্বকে আমাদের দেশ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, জনগণ ও ভূগোল সম্পর্কে জানতে দিচ্ছি না।

হয়ত অনেকেই জানেন না উইকিপিডিয়া একটি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গড়ে উঠা বিশ্বকোষ, সেচ্ছাসেবকরা যখন সময় পান তখন কন্ট্রিবিউট করেন। এখানে কন্ট্রিবিউটের জন্য বড় কোন স্কলারও হতে হয় না, এর নীতিমালাই হল পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ সবকিছু জানে না কিন্তু সবাই কিছু না কিছু জানে সুতরাং সবার জ্ঞান যদি একই প্লাটফর্মে শেয়ার করা যায় তখনই সেটা পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠে। সাড়া বিশ্বের হাজার হাজার সেচ্ছাসেবক এভাবেই উইকিপিডিয়া সম্বৃদ্ধ করে যাচ্ছেন। তারা এটা করতে পছন্দ করেন কারন তার পৃথিবীর সব মানুষের জ্ঞানে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকারের আইডিয়াটি ভালোবাসেন। এখানে কাউকে স্পেসিফিকালি কোন কাজ দেওয়া হয় না যে যা করতে ভালোবাসেন তাই করেন। এটা আসলে এক ধরণের মজা সেইসাথে শিক্ষামুলকও।

উন্মুক্ত জ্ঞানে প্রবেশাধিকার ও বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য জ্ঞানের কিছু অংশ রেখে যাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা এড়িয়ে চলা খুবই কঠিন যখন আপনি ইচ্ছে করলেই এই দৈতাকার কর্মযজ্ঞে খুব সহজেই শামিল হতে পারছেন। এখানে জাতীয়তা, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও লিঙ্গ ভিত্তিক কোন ব্যারিয়ার নেই। আপনি যদি স্বেচ্ছায় জ্ঞান বিতড়নের কাজটি পছন্দ করেন ও উইকিপিডিয়ার আর্টিকেলে সন্তুষ্ট না হন তাহলে আপনিও যোগদান করতে পারেন। উইকিপিডিয়া আর্টিকেল সম্পাদনা খুবই সহজ পাতার উপরে ‘Edit' লেখা বাটনে ক্লিক করুন ও ইডিট করা শুরু করুন। আপনাকে ইডিটের জন্য একাউন্টও তৈরি করতে হবে না তবে একাউন্ট তৈরি করে নিতে পারেন তাহলে ইডিটগুলো আপনার নামে অ্যাট্রিবিউট হবে এবং অন্যরা আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন।

আপনি যদি ভালো কিছু লিখেন, এটা সম্ভবত শতাব্দীধরেই ইন্টারনেটে বিচরন করবে। অবশ্যই এটা আপনার এবং আপনার সন্তানরা এটা ব্যবহার করতে পারে। আমি আপনাকে বলতে পারি, আপনার জ্ঞান ইন্টারনেটে থাকবে ও হাজার হাজার মানুষ এটা পড়বে, এটার চেয়ে ভালো অনুভুতি কিছুই হতে পারে না। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মঙ্গল, আপনার জন্যও!

It’s important that we all have to put little effort into improve Bangladeshi content – opening up our country and people to the world through this remarkable and dynamic project. Let knowledge be free, where everybody can access!

তথ্যসূত্রঃ উইকিমিডিয়া পরিসংখ্যান। এই সিরিজের পরবর্তি এপিসোড এখানে

Level 0

আমি যুদ্ধ মন্ত্রী। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 9 বছর 7 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 7 টি টিউন ও 3 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।

Just another user from planet Earth! https://twitter.com/nahidunlimited


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

thnks bro it’s really appreciate. please write more for wiki

    আসলে আমার এই পোস্টের উদ্দেশ্যই হলো বাংলাদেশে যারা অনলাইনে থাকেন তাদের একটু সচেতন হওয়ার আহবান। আমরা নিজেরা নিজের দেশে মুক্তিযুদ্ধ বলে বলে যতই চিল্লা চিল্লি করি না কেন, এগুলো বাইরের দেশের মানুষের কানে খুব কমই পৌঁছায় কারণ তাদের যা তথ্য দরকার তারা সেটা অনলাইন সার্চ করেই নিয়ে নেয়। সুতরাং দেশে সবার মধ্যে চেতনা তৈরির পাশাপাশি অনলাইনেও যাতে আমাদের কনটেন্টগুলো সঠিক থাকে এদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।