সুই সুতার খেলা – আসুন ভিন্নধারার কিছু দেখি।

আমার নতুন টিউনে সবাইকে স্বাগতম।

শুরুতেই বলে রাখি এটা কোন কম্পিউটার রিলেটেড টিউন নয়, কিন্তু এটি টেকনিক্যাল টিউন। কমবেশি আমরা অনেকেই সেলাই মেশিনের সাথে পরিচিত। অনেকের বাসায় সেলাই মেশিন থাকতেও পারে। যেগুলো আমরা বেশি দেখি সেগুলো বেশিরভাগই ‘লক স্টিচ’ সুইং মেশিন। টিটিতে ফ্যাশন ডিজাইন বা গার্মেন্টস সেকশনের কোন রিডার আছে কিনা জানা নেই, তবে আমার আগ্রহ ছিলো এই মেশিন দুইটা সুতা দিয়ে কিভাবে সেলাই করে সে সম্পর্কে জানার। যাই হোক-যা জানলাম তাই আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

প্রথম সেলাই মেশিন তৈরি হয় আমেরিকাতে ১৮৪৬ সালের ১০-ই সেপ্টেম্বর। ফ্যাক্টরিতে প্রোডাকশন লাইনে কাপড় সেলাইয়ের জন্য ব্যবহার করা হত। চাইলে এখান থেকে দেখে নিতে পারেন। সেলাইয়ের ধরনের উপরে ভিত্তি করে মেশিন গুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরির হয়ে থাকে। যেমন- লক স্টিচ, চেইন স্টিচ, বারটেক, জিগজ্যাগ, বাটন হোল/এটাচ, এমব্রয়ডার ইত্যাদি। তবে সব সুইং মেশিন ই একটা কমন থিওরি মেনে চলে, সেটা হলো সূচ আর সুতার গিট্টু দেয়া বা প্যাঁচ লাগানো। উপর থেকে সূচ সুতা সহ কাপড় ভেদ করে নিচে চলে যায়, একই মুহুর্তে নিচে থেকে একটি লুপার/হুক উপর থেকে আসা সুতাটার ভিতরে ঢুকে নিজের সুতার সাথে প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়। মজার ব্যাপার তাই না? আসলে আমার কাছে এই সূচ-সুতার খেলাটা ভালো লেগেছে। আশাকরি, আপনারা যারা জানেন না তাদের কাছেও ভালো লাগবে। আর যদি কারো ভালো না লাগে প্লিজ- আজেবাজে টিউমেন্ট করবেন না।

 

উপরের চিত্রটি একটি কমনলক স্টিচসুইং মেশিনের।

১.স্পুল পিন-এটা আপার নিডেলের সুতার রোল রাখার জন্য ব্যবহার হয়।

২.মেশিন পুলি- এটা থেকেই মেশিন স্টার্ট হয়, এটা হাত দিয়ে ঘোরানো হয়/পায়ের সাহায্য প্যাডেল দিয়ে ঘোরানো হয়/ইলেক্ট্রিক মোটর দিয়ে ঘোরানো হয়। এর সাথে সংযুক্ত থাকে নিডেলকে আপডাউন করানোর আর্ম শ্যাফট ও আপরাইট আর্ম শ্যাফট।

৩.আপরাইট আর্ম শ্যাফট- নিচের সুতা আর নিডেল কে ঘোরানোর কাজ করে।

৪.কানেক্টিং রড-কাপড় কে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার ‘ফীড-ডগ’ কে সামনে পিছনে চালিত করে।

৫.লুপ ট্যাকার(শাটল)-এটা উপরের নিডেলের সুতাকে টেনে নিজের সাথে প্যাঁচ লাগায়।

৬.ববিন কেস-এটার মাঝে ববিনের সাথে নিচের সুতা প্যাঁচানো থাকে।

৭.ফিড ডগ-কাপড় কে সামনের দিকে ঠেলে দেয়।

৮.প্রেশার ফুট-কাপড় কে নিচের দিকে ফীড-ডগের সাথে চেপে ধরে রাখে।

৯.প্রেশারবার লিফটার-প্রেশার ফুট কে উপর দিকে তুলে ধরে লক করে রাখতে সাহায্য করে।

১০.প্রেশারবার-প্রেশার ফুট কে নিদৃর্ষ্ট চাপের স্কেলে ধরে রাখে।

১১.থ্রেড টেক আপ লিভার- আর্ম শ্যাফটের ঘুর্নায়মান গতি কে নিডেল বারের আপডাউনে মুভ করিয়ে দেয়।

১২.নিডেল থ্রেড টেনশন এসেম্বলি-উপরের সুতাকে নিদৃর্ষ্ট টানে ধরে রাখে।

১৩.নিডেল বার-সূচ কে উপরে নিচে উঠা নামা করায়।

১৪.নিডেল-আর কি! নিডেল মানেই তো সূচ।

 

সেলাইয়ের মুলমন্ত্র হচ্ছে দুই প্রান্তের সূচের টাইমিং আর সুতার সঠিক টান বজায় থাকা। যে মুহুর্তে উপরে থেকে নিডেল নিচে সুতা সহ আসবে একই সময়ে নিডেলের সুতাটাকে নিচের সুতার সাথে একটা প্যাঁচ লাগিয়ে দিতে হবে। দুই নিডেলের টাইমিং ভালো না হলে সেলাই হবে না। আর দুই সুতার টান সমান না হলে সেলাই কুচকে বা জড়িয়ে যাবে। সুতা এমনি এমনি বের হবে না বা জোরে টান দিয়ে বের করতে হবে না। অর্থাৎ হালকা টানে সুতা বের হবে যদিও এটা মেশিনের ক্যাটাগরির উপরে নির্ভর করে।

লক স্টিচঃ-

অতি সাধারণ কিন্তু সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় লক স্টিচ। এই সেলাইয়ে নিডেল সুতা সহ কাপড় ভেদ করে নিচে যায়, একই সময়ে নিচে রোটারি হুক সুতাটাকে টেনে নেয়। আর রোটারী হুকের মাঝে ববিনের সাথে সুতা থাকে। নিচের মুভিং পিকচার টি দেখুন-

 

লক স্টিচ মেশিন দুই রকমের হয়ে থাকে। ১.সিংগেল নিডেল ২.ডাবল নিডেল

চেইন স্টিচঃ-

এই মেশিনে কোন রোটারি হুক থাকে না। নিচের অংশে লুপার নামে নিডেলের মত একটি সূচ থাকে। যেটা নিডেলের সুতার সাথে লুপ বানিয়ে দেয়। এই সেলাই দেখতে চেইনের মত হয়। এই ভিডিও টি দেখতে পারেন

বারটেকঃ-

কাপড়ের যে অংশে বেশি প্রেশার পড়ে সেখানে বারটেক করা হয়ে থাকে। যেমন- ব্যাগ, জিন্স প্যান্ট, জুতা এগুলো তে বারটেক করে দেয়া হয়। বারটেক মেশিনে আগে থেকেই স্টিচ/সেলাই গুনে গুনে সেট করে করা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। চাইলে ভিডিও টি দেখে নিতে পারেন।

বাটন হোল/এটাচঃ-

কাপড়ে বোতাম লাগানো আর বোতামের পকেট বানানোর জন্য বাটন হোল আর এটাচ মেশিন দিয়ে কাজ করা হয়

আসলে মেশিনের এই ছোট ছোট যন্ত্রাংশ গুলো কিভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে টাইমিং করে কাজ করে, তা নিজ চোখে না দেখলে বুঝা কঠিন। আর হয়ত ভালো কোন টিউনার এইটা নিয়ে টিউন করলে আপনাদের আরো ভালোভাবে বুঝাতে পারতেন। তবে আপনারা চাইলে যে কোন গার্মেন্টস গিয়ে একটু সময় নিয়ে দেখে আসতে পারেন।

পরিশেষঃ-

এতো কষ্ট করে যেহেতু টিউন পড়লেন, তাহলে কিছু আশার বাণী শুনাই।

গার্মেন্টস শিল্পের অন্যতম এই বাংলাদেশে গার্মেন্টস এর অভাব নেই। ফ্যক্টরিতে এই মেশিন গুলো কাজ করে ফলে নষ্ট হওয়া খুব স্বাভাবিক। আর নষ্ট হবার পর যদি মেশিন না সারিয়ে, ফেলে রাখা হয় তাহলে ব্যবসা ধ্বংস হবে। তাই সব সময় কাজ করার জন্য ফ্লোর প্রতি ২/১ জন করে মেকানিক নিয়োগ দেয়া হয়। মেকানিকের স্টার্টিং বেতন ১০হাজার থেকে শুরু। এরপর কাজের দক্ষতা অনুযায়ী ও কোম্পানী অনুযায়ি বেতন দেয়। আপনাদের পরিচিত কেউ লেখাপড়ায় একেবারেই বিফল হলে তাকে এই কাজের প্রেরনা দিতে পারেন। এখানে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে হয়ত লাইফ গেইন হয়ে যাবে।

 

যারা ছোটখাটো ফ্যাক্টরি দিয়ে দেশিয় বাজার ধরতে চান তাদেরও ধারনা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করি। একটি পরিপুর্ন প্রডাকশন লাইন বানানোর জন্য। নুন্যতম ২টা সিংগেল নিডেল লকস্টিচ, ১টা ডাবল নিডেল লক স্টিচ, ১টা ওভারলক, ২টা বাটন হোল/এটাচ(কম্পিউটার), ১টা বারটেক(কম্পিউটার) ও ২টা স্টিম আয়রন। সব মিলিয়ে নতুন কিনলে ২৫/৩০ লাখের মধ্যেই হবে, অথবা গার্মেন্টস থেকে ভালো পুরনো মেশিন নিতে পারেন, তাহলে সবগুলো ১০/১২ লাখের মধ্যেওই পেয়ে যাবেন।

ভালো থাকুন। ধন্যবাদ এতো কষ্ট করে টিউন পড়ার জন্য।

Level 2

আমি জনি আহমেদ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 9 বছর 7 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 25 টি টিউন ও 301 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

Level New

খুবি পরিচিতই একটি যন্ত্র কিন্ত এ সম্পর্কে কিছুই জানা ছিলো না। আপনাকে
ধন্যবাদ যে এটা সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান হলেও দিতে পেরেছেন।
টিউমেন্ট নেই বলে উৎসাহ হারাবেন না ।

    ধন্যবাদ … আপনার মতামতের জন্য। সবসময় চেষ্টা করি নতুন কিছু দেয়ার জন্য…

অনেক কিছু জানতে পারলাম । অসংখ্য ধন্যবাদ ।

    আপনাকেও ধন্যবাদ এত কষ্ট করে টিউন পড়ার জন্য।

Level 2

Thanks

Level 0

সুতোর দুটো মাথাই উপরে থাকে লক হয় ক্যামনে?

    সুতা নিচে ববিন কেসের মাঝে থাকলেই লক স্টিচ হয়…

প্রিয়তে রাখলাম , সময় করে পরে পড়ে নেব ।

Level New

জানার আগ্রহ ছিলো।
আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম।
ধন্যবাদ!!!

আপনি তো মশাই সেই রকম একজন মানুষ! এতো সুন্দর লেখনি এতোদিন কই লুকিয়ে রাখছিলেন। অসাধারন লাগলো 🙂

    ধন্যবাদ। ভাইয়া আপনার সুন্দর মন্তব্যর জন্য। জানতে ইচ্ছে করে, তাই আগে জানার চেষ্টা করি তারপরেই জানিয়ে দিতে চেষ্টা করি , ইদানিং ব্যস্ততার জন্য কিছুই লিখতে পারছি না। 😉