কণা পদার্থবিদ্যার ভিত্তিঃ যা দিয়ে তৈরি আমরা ও মহাবিশ্ব

আমরা কি দিয়ে তৈরি? কি দিয়ে তৈরি আমাদের এই রহস্যময় মহাবিশ্ব? এসব প্রশ্ন নতুন নয়, বরং আজকে আমরা এক দুই করে ২০১৪ পর্যন্ত যে সাল গণনা করে এসেছি সেই গণনা শুরুর অনেক আগে থেকেই এসব মানুষের মনে জেগেছিল। এর পেছনে কারনও আছে। মানুষ যেহেতু কৌতূহলী প্রাণী আর সে জানতে চায় তার আশে পাশের সকল রহস্যকে, তাই সে জানতে চায় সৃষ্টি সম্পর্কে। এক দিক দিয়ে মহাবিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এটি। মানুষের এই প্রশ্নের উত্তরের অনুসন্ধান শুরু হয় ভারতীয় বিজ্ঞানী কনাদ ও গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস এর মাদ্ধমে। মানুষ তখন বুঝে ফেলেছিল যে, এমন কিছু আছে যা দিয়ে সবকিছুই তৈরি সম্ভব। তাই তারা সবকিছু ভাঙতে শুরু করল। কিন্তু এটাতো আর নারিকেল নয় যে বললেই ভাঙা সহজ। আর আমাদের চোখেরও তো একটা সীমা আছে নাকি? তাই সে সময় সবকিছুই যার যার দর্শন দিয়ে প্রকাশ করত। আর এক্ষেত্রে কাজ করত ‘প্রভাব’। অর্থাৎ যার প্রভাব ছিল বেশি, তার কথাই গ্রহনযোগ্যতা পেত। তাই তখন অনেক বিভ্রান্তি ছিল। কিন্তু আজ তার আর কোন স্থান নেই। কারন এখন আমাদের আছে উন্নত প্রযুক্তি। আমরা এখন প্রায় সবকিছুই ভাঙতে পারি। তাই আমাদের কাছে এখন এসব প্রশ্নের মোটামটি একটা উত্তর আছে। তো চলুন আমরা এখন এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।
আমরা যখন ভাঙতে শিখলাম তখন আমাদের কাছে একটা নতুন পদ্ধতি আসল। সেটা হল প্রোটন প্রোটন সংঘর্ষ করান। এই সংঘর্ষ যে যন্ত্রে করা হয় তাকে কনা ত্বরক যন্ত্র বলা হয়। বর্তমানে পৃথিবীর সবথেকে বড় কনা ত্বরক যন্ত্র হল LHC (Large Hadron Collider)। এটা সুইজারল্যান্ড ও জেনেভার কাছে মাটির ১৭৫ মিটার নিচে স্থাপন করা হয়েছে। এর কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে এবং শেষ হয় ২০০৮ সাল নাগাদ। তো যাই হোক, এই যন্ত্রে প্রোটনের মদ্ধে সংঘর্ষ করে দেখা গেছে প্রতি বারই নতুন নতুন কনা সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে প্রায় ৪০০ কণা পাওয়া যায়। তাই পদারথ বিজ্ঞানীরা জটিলতা এড়ানোর জন্য একটা নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করেন এবং এটা অনুসরণ করেই বর্তমানে তারা মৌলিক কণাদের অনুসন্ধান করছে। তাদের মতে মৌলিক কণিকাগুলোর কিছু বিশেষ ধর্ম থাকে যেগুলো দ্বারা এর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়, যেমনঃ ভর, বৈদ্যুতিক আধান, স্পিন ইত্যাদি। এই নিয়ম মতে বর্তমানে যে তত্ত্বটি সবথেকে বেশি গ্রহণযোগ্য তা হল ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ থিওরি।
আমরা যদি বলি আমাদের চার পাশে কি আছে? তাহলে E=mc^2 মতে বলতে হয় পদার্থ আর শক্তি। তাই সমগ্র মহাবিশ্বকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগের নাম ফার্মিওন আর অপর ভাগের নাম বোসন। ফার্মিওন হল পদার্থ কণা আর বোসন হল শক্তি কণা যা পদার্থ কনার মদ্ধে শক্তি ও ভর সৃষ্টির জন্য দায়ী। ফার্মিওন নামটি ইতালিও বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নাম থেকে নেয়া আর বোসন নামটি নেয়া হয়েছে আমাদের বাঙালী বিজ্ঞানী সত্তেন্দ্রনাথ বসুর নামে। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষক ছিলেন এবং জগদীশচন্দ্র বসুর ছাত্র ছিলেন। বোসনের স্পিন থাকে শূণ্য অথবা পূর্ণ সংখ্যা (০, ১, ২….) এবং ফার্মিয়নের স্পিন থাকে পূর্ণ সংখ্যার অর্ধেক (১/২, ৩/২, ৫/২….)। ফার্মিয়ন ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান এবং পাউলি-র বর্জন নীতি মেনে চলে। এ নীতি অনুসারে একাধিক ফার্মিয়ন একই সময়ে একই স্থানে অবস্থান করতে পারে না, ফলে বাস্তবেও আমরা দেখি এক বস্তু অন্য বস্তুকে ভেদ করে যেতে পারে না। অপরদিকে বোসন বর্জন নীতি অনুসরন না করায় সহযেই একে অপরকে ভেদ করতে পারে (যেমন – আলো এবং অন্যান্য তড়িতচুম্বকীয় তরঙ্গ)। বোসন বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান অনুসরন করে।

স্ট্যান্ডার্ড মডেল

ফার্মিয়নঃ ফার্মিয়ন মোট ১২ রকমের হয়, এদের প্রত্যেককে এক একটি ফ্লেভার [Flavor] বলে (এর সাথে কিন্তু

স্বাদ গ্রহনের কোন প্রকার সম্পর্ক নেই)। রিচার্ড ফাইনম্যান তাই মজা করে বলেছিলেন “বেচারা বিজ্ঞানীরা কোয়ার্কদের এই আন-কনভেন্সনাল পোলারাইজেশন বুঝানোর জন্য আর গ্রীক লেটার পেলেন না যে রংঙকেই বেছে নিতে হল। ”।
১২টি ফার্মিয়নের আবার অনুরূপ ১২টি প্রতিকণিকা (Antiparticle) আছে (যেমন ইলেক্ট্রনের প্রতিকণিকা পজিট্রন)। ফার্মিয়নের মধ্যে দুইটা ভাগ আছে, কোয়ার্ক এবং লেপ্টন।
কোয়ার্ক ছয়টি ফ্লেভারের হয় – আপ u, ডাউন d, চার্ম c, স্ট্রেঞ্জ s, টপ t, বটম b। এরা একা থাকতে পারে না, সবসময় দুইটি বা তিনটির গ্রুপ গঠন করে। তিনটি কোয়ার্কের (অথবা তিনটি অ্যান্টিকোয়ার্কের) গ্রুপকে ব্যারিয়ন বলে। যেমনঃ প্রোটন p (আপ-আপ-ডাউন), নিউট্রন n (আপ-ডাউন-ডাউন), ওমেগা Ω− (স্ট্রেঞ্জ-স্ট্রেঞ্জ-স্ট্রেঞ্জ) ইত্যাদি। একজোড়া কোয়ার্ক-অ্যান্টিকোয়ার্কের গ্রুপকে মেসন বলে। যেমনঃ ধনাত্মক পাইওন π+ (আপ-অ্যান্টিডাউন), ঋনাত্মক পাইওন π- (অ্যান্টিআপ-ডাউন), চার্মড ইটা মেসন ηc (চার্ম-অ্যান্টিচার্ম) ইত্যাদি। ব্যারিয়ন ও মেসনকে একত্রে হ্যাড্রন বলে। ইউরোপের প্রভাবশালী বিজ্ঞান সংস্থা সার্নের (ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ) লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে (LHC) এই হ্যাড্রনেরই অতিউচ্চগতির সংঘর্ষ ঘটানো হয়।
ফার্মিয়নের আরেকটি ভাগ হল লেপ্টন। এরা একা থাকতে পারে। সবচেয়ে পরিচিত লেপ্টন হল ইলেকট্রন e। এছাড়াও মিউওন μ, টাউওন τ এবং এ তিনটির অনুরূপ নিউট্রিনো আছে যথা ইলেকট্রন নিউট্রিনো νe, মিউওন নিউট্রিনো νμ, টাউওন নিউট্রিনো ντ লেপ্টনের অন্তর্ভুক্ত।
১২টি ফার্মিয়নকে আবার ৩টি জেনারেশনে ভাগ করা হয় – I, II এবং III.
জেনারেশন I-এর চেয়ে জেনারেশন II-এর কণিকাগুলোর ভর বেশি, আবার জেনারেশন II-এর চেয়ে জেনারেশন III-এর কণিকাগুলোর ভর আরও বেশি। প্রত্যেক জেনারেশনের ভেতরে আবার কোয়ার্কের ভর লেপ্টনের চেয়ে বেশি। লেপ্টনের মধ্যে নিউট্রিনোগুলোর ভর সবচেয়ে কম, প্রায় নেই বললেই চলে। প্রত্যেক জেনারেশনের প্রথম কোয়ার্কের বৈদ্যুতিক আধান +২/৩, দ্বিতীয় কোয়ার্কের আধান -১/৩, ভারী লেপ্টনের আধান -১ আর নিউট্রিনোর কোন আধান নেই। প্রথম জেনারেশনের আধানযুক্ত কণিকাগুলো দিয়েই মূলত আমাদের চারপাশের জগত গঠিত। অন্যান্য জেনারেশনের আধানযুক্ত ভারী কণিকাগুলো শুধু অতি উচ্চশক্তিসম্পন্ন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় এবং অতিদ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে হালকা স্থিত কণিকায় রুপান্তরিত হয়। আর আধানবিহীন নিউট্রিনোগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না এবং অন্যান্য কণিকার সাথে তেমন কোন প্রতিক্রিয়াই দেখায় না।
এই ধর্মের জন্য সাম্প্রতিক কালের আলোর-চেয়ে-দ্রুতগতির-কণার-অস্তিত্ব-নিয়ে-প্রশ্ন-তোলা আলোচিত অপেরা এক্সপেরিমেন্টে মিউওন নিউট্রিনো ব্যবহার করা হয়েছিল।
বোসনঃ বোসন মোট ২ প্রকার – গেজ বোসন ও হিগ্‌স বোসন। গেজ বোসন বলের বাহক হিসেবে ক্রিয়া করে। এর স্পিন ১। মৌলিক বল চার প্রকার – তড়িতচুম্বকীয় বল, সবল নিউক্লীয় বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল এবং মাধ্যাকর্ষন বল। গেজ বোসন প্রথম তিনটির সাথে সম্পর্কিত।
উপরের ছকটার ডানের চারটি হল বোসন পার্টিকেল। এগুলো মৌলিক বোসন। আমরা একটু আগে যে বলবহনকারী পার্টিকেলের কথা বোলেছিলাম, ঐ গুলোই বোসন। এরকম পার্টিকেলগুলো হল ফোটন, গ্লুওন আর W এবং Z পার্টিকেল।

যে পার্টিকেল তড়িৎচুম্বকীয় বল বহন করে তাই হল ফোটন। আমরা ছোটবেলা থেকে কখনও জেনেছি, আলো হল ফোটন কখনও জেনেছি আলো হল তড়িৎচুম্বক বিকিরণ। কিন্তু এখন নিশ্চয়ই পরিস্কার হয়ে গেল, তাই না? আমরা পড়েছি যে ক্ষুদ্র পাল্লার মধ্যে কার্যকরি সবথেকে শক্তিশালী বল হল সবল নিউক্লিও বল আর এই বল কিন্তু বহন করে এই গ্লুওন পার্টিকেল। W আর Z পার্টিকেল দুর্বল নিউক্লিও বল বহন করে। এই দুটি আবার একে অন্যের অ্যান্টিপার্টিকেল। ছক থেকে আমরা বোসনগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য নোট করে রাখতে পারি। সেটা হল, এই কণাগুলির প্রত্যেকটির স্পিন হল পূর্ণসংখ্যা।
আগেই বলেছি কালার চার্জ হল কোয়ার্ক আর গ্লুওনের একটা বিশেষ ধর্ম। সাধারণ চার্জিত বস্তুগুলি পারস্পরিক তাড়িতচুম্বক মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয় ফোটনের মাধ্যমে। আর কালার চার্জ কাজ করে গ্লুওনের মাধ্যমে। এই গ্লুওন থেকেই সবল নিউক্লিও বল সৃষ্টি হয়। তাই নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারেছন যে, সাধারণ চার্জ থেকে কালার চার্জে অনেক বেশি শক্তিশালী মিথস্ক্রিয়া হয়। কিন্তু কখনও এই কালার চার্জ মুক্ত থাকে না। কোয়ার্কগুলি যেসব হ্যাড্রন তৈরি করে সেগুলোতে সব সময় নিট কালার চার্জ শুন্য হয়।
কালার চার্জ মূলত তিনটি- রেড, গ্রিন আর ব্লু। তবে প্রত্যেকটির একটি করে অ্যান্টি-কালার আছে। একটি কোয়ার্ক একটি কালার ধারণ করে, একটি অ্যান্টি কোয়ার্ক ধারন করে একটি অ্যান্টিকালার। আর একটি গ্লুওন ধারন করে একটি কালার এবং একটি একটি অ্যান্টিকালার। তবে, সবাই সাবধান, আমরা কোন বস্তুকে চখে যে রঙে দেখি তার সাথে কিন্তু এই কালারের কোন সম্পর্ক নেই। চার্জিত বস্তু তড়িৎ ক্ষেত্রে থাকে, কালার-চার্জিত বস্তুরও তেমনই রয়েছে কালার চার্জ ক্ষেত্র।

মৌলিক বল

আমরা আগে বলেছিলাম যে মৌলিক যে চারটা বল আছে তার সাথে বোজনের সম্পর্ক রয়েছে। এখন দেখা যাক সম্পর্কটা কি।
তড়িৎচুম্বকীয় বলঃ বৈদ্যুতিক আধানযুক্ত কণিকাগুলোর মধ্যে তড়িৎচুম্বকীয় বল ক্রিয়া করে। এর পাল্লা অসীম, শক্তি সবল নিউক্লীয় বলের চেয়ে কম কিন্তু দুর্বল নিউক্লীয় বলের চেয়ে বেশি। এর বাহক হল ফোটন γ, যার নিজের কোন ভর বা আধান নেই। এ সংক্রান্ত তত্ত্বকে কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডিনামিক্স (QED) বলে।
সবল নিউক্লীয় বলঃ কালারযুক্ত কণিকা অর্থাৎ কোয়ার্কসমূহ ও গ্লুওন g-এর মধ্যে সবল নিউক্লীয় বল ক্রিয়া করে। কোয়ার্ক কখনও একা থাকতে পারে না, সবসময় দুইটি (মেসন) বা তিনটির (ব্যারিয়ন) গ্রুপ গঠন করে। লাল, সবুজ ও নীল আলো মিলে যেমন রঙবিহীন বা সাদা আলো গঠন করে, তেমনি কোয়ার্কও এমনভাবে গ্রুপ গঠন করে যেন সবগুলো মিলে সাদা বা রঙবিহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাই ব্যারিয়নে সবসময় থাকে লাল, সবুজ ও নীল কোয়ার্ক এবং মেসনে থাকে যে কোন একটি কালার ও তার অ্যান্টিকালার (অ্যান্টিকোয়ার্ক থেকে)।
সবল বল নিউক্লীয় বলের পাল্লা খুবই ক্ষুদ্র, মাত্র ১০-১৫ মিটারের মত। এ বলের কারণেই কোয়ার্ক প্রোটন বা নিউট্রনের মত হ্যাড্রন গঠন করে। এ ক্ষেত্রে বলের বাহক হল গ্লুওন, এটি আঁঠার (glue) মত কাজ করে বলে এর নাম দেয়া হয়েছে gluon। ফোটনের মত গ্লুওনেরও নিজের কোন ভর বা আধান নেই। গ্লুওন ৮ প্রকার, তবে সেগুলো কোয়ার্কের চেয়ে অনেক জটিল, ৮টি কালার-অ্যান্টিকালারের জোড় হিসেবে থাকে। নিজস্ব পাল্লার ভেতর সবল নিউক্লীয় বলের শক্তি অন্যান্য মৌলিক বলের চেয়ে অনেক বেশি, প্রোটন ও নিউট্রন গঠনের পরও অতিরিক্ত থাকা বল তড়িতচুম্বকীয় বলকে পরাহত করে পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠন করে। এ অতিরিক্ত সবল নিউক্লীয় বলের বাহক হল মেসন। সবল নিউক্লীয় বলের আরেকটি স্পেশাল বৈশিষ্ট্য হল এর পাল্লার মধ্যে দুইটি কণিকার দুরত্ব যত বাড়ে, এদের মধ্যকার বল ততই বৃদ্ধি পায়, যা তড়িতচুম্বকীয় বল ও মাধ্যাকর্ষন বলের ঠিক বিপরীত। তাই কোয়ার্ককে কখনও আলাদা করা যায় না। কারন দুইটি কোয়ার্ককে আলাদা করতে চাইলে প্রচুর পরিমাণ শক্তি সরবরাহ করতে হবে, আর এদের মধ্যে দুরত্ব যত বাড়বে শক্তির পরিমাণও তত বাড়াতে হবে, ফলে একসময় শক্তির পরিমাণ এতই বাড়বে যে কোয়ার্কদুটি আলাদা হয়ে ঐ শক্তি থেকে অ্যান্টিকোয়ার্ক উৎপন্ন করে আবার নতুন করে কোয়ার্ক-অ্যান্টিকোয়ার্ক জোড় গঠন করবে। সবল নিউক্লীয় বল সংক্রান্ত তত্ত্বকে কোয়ান্টাম ক্রোমোডিনামিক্স (QCD) বলে।
দুর্বল নিউক্লীয় বলঃ ফ্লেভারযুক্ত কণিকা অর্থাৎ ফার্মিয়নের মধ্যে দুর্বল নিউক্লীয় বল ক্রিয়া করে। এটি খুব দুর্বল বল এবং এর পাল্লা সবল নিউক্লীয় বলের চেয়েও ক্ষুদ্র, মাত্র ১০-১৮ মিটারের মত। এর দ্বারা পরমাণুর তেজষ্ক্রিয় ক্ষয় ব্যাখ্যা করা যায়। এর বাহক হল W+, W- ও Z0 বোসন (কোন কোন ক্ষেত্রে হিগ্‌স বোসনকেও ধরা হয়)। এদের নিজস্ব ভর আছে, এর মধ্যে Z0-এর ভর সবচেয়ে বেশি। এদের নিজস্ব আধানও আছে, W+-এর আধান +১, W–এর আধান -১ এবং Z0 আধান নিরপেক্ষ। দুর্বল নিউক্লীয় বল সংক্রান্ত তত্ত্বকে কোয়ান্টাম ফ্লেভারডিনামিক্স (QFD) বলে। তবে তড়িতচুম্বকীয় বল ও সবল নিউক্লীয় বলকে একত্রে ইলেক্ট্রোউইক থিওরীতে (EWT) আলোচনা করা হয়।
মাধ্যাকর্ষন বলঃ এটি ক্রিয়া করে সকল কণিকার মধ্যে। এটি খুবই দুর্বল বল, কিন্তু এর পাল্লা অসীম এবং সবসময়ই শুধুমাত্র আকর্ষণ করে। স্ট্যান্ডার্ড মডেল তত্ত্ব এটি ব্যাখ্যা করতে পারে না। ধারণা করা হয় এ বলেরও একটি বাহক আছে, এর প্রস্তাবিত নাম গ্র্যাভিটন। এটি একটি ভরবিহীন কণিকা যার স্পিন ২। মাধ্যাকর্ষন বল সংক্রান্ত তত্ত্বকে কোয়ান্টাম জিওমেট্রোডিনামিক্স (QGD) বা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটেশন বলে।

যার নাম ঈশ্বরকণা

হিগ্‌স বোসন স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কণিকা, কারণ এটি ফোটন ও গ্লুওন বাদে অন্যান্য সকল কণিকার ভর থাকার কারণ ব্যাখ্যা করে। ধারণা করা হয়, ভরের উৎপত্তি ঘটে মৌলিক কণিকার হিগ্‌স ক্ষেত্রে পরিভ্রমনের জন্য। এই হিগ্‌স ক্ষেত্রের ক্ষুদ্রতম অংশই হল হিগ্‌স বোসন। এর স্পিন হল ০। স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে, হিগ্‌স বোসন না থাকলে সকল কণিকাই ভরবিহীন হত। এটিই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের একমাত্র কণিকা যেটি আবিষ্কার করার জন্য বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বেশি খাটতে হয়েছে। একে অনেকে ঈশ্বরকণাও বলে থাকে। এলএইচসিতে(LHC) এর অস্তিত্বও কিছুদিন আগে পাওয়া গেছে।
তো এই হল মোটামটি আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য। এইসব কণাগুলো দিয়েই তৈরি আমরা আর আমাদের এই সৃষ্টিজগত। সহজ ভাবে বলতে গেলে আমাদের মহাবিশ্বকে শক্তি আর পদার্থ হিসেবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। আমরা একটু লক্ষ্য করলে দেখব যে, যদি আমরা একটা কাঠের আলমারি বানাই তাহলে আমাদের দরকার হবে কাঠ ও কিছু আঠা। এই আঠা কাঠকে জোড়া লাগাবে। আমরা যদি সারা জীবনও আঠা ছাড়া কাঠগুলোকে রেখে দেই তাহলে কি এগুলো জোড়া লাগবে? না লাগবে না। ঠিক এমনিভাবে আমরা যদি ফার্মিয়নদের একসাথে রেখে দেই তারা কোন দিনও জোড়া লাগবে না। কিন্তু প্রকৃতিতে দেখা যায় এরা একসাথে থাকে। তাহলে এদের এক সাথে রাখার জন্য নিশ্চই কোন বল কাজ করছে। এই বলই হল বোসন কণা। অর্থাৎ ফার্মিয়নকে কাঠ হিসেবে ধরা হলে বোসন হল আঠা।
এত কিছু ব্যাখ্যা করার পরেও বলতে হয় স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। যেমন– এ তত্ত্বে ডার্ক ম্যাটারের কোন স্থান রাখা হয়নি, এ তত্ত্ব মাধ্যাকর্ষন বল ব্যাখ্যা করতে পারে না। এ সত্ত্বেও স্ট্যান্ডার্ড মডেলের গুরুত্ব অপরিসীম, তাই একে বলা হয় প্রায় সবকিছুর তত্ত্ব (Theory of almost everything)। আমরা জানি থিউরি অফ রিলেটিভিটি মহাবিশ্বের বৃহৎ সবকিছুকেই ব্যাখ্যা করতে পারে। এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স কাজ করে ক্ষুদ্রতম ক্ষেত্রে। কিন্তু রিলেটিভিটি ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিজ নিজ ক্ষেত্রে সঠিক ভাবে সব কিছু ব্যাখ্যা করতে পারলেও যখন এদের একসাথে করা হয় তখন পরস্পরের সাথে বিরোধ দেখা যায়। বর্তমানে এই বিষয়টাই মনে হয় পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে সব থেকে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই পদার্থ বিজ্ঞানীদের মূল লক্ষ্য হল রিলেটিভিটি ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে একত্রিত করা। অর্থাৎ এমন একটা তত্ত্ব দাড় করানো যা দিয়ে মহাবিশ্বের সবকিছুই ব্যাখ্যা সম্ভব। পদার্থবিজ্ঞানীদের মতে, সবগুলো মৌলিক বল একত্রিত করে একটি সবকিছুর তত্ত্বও (Theory of everything) বের করা সম্ভব। স্ট্রিং থিউরি যার অন্যতম উদাহরণ।


বি.দ্রঃ এই আর্টিকেলটি আগে বিজ্ঞান বাংলা ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল।
লেখকঃ রাশেদ মাহমুদ, শাবিপ্রবি।
[লেখাটি বিজ্ঞান বাংলা প্রকাশিত গ্যালাক্টিকা ম্যাগাজিনের জানুয়ারি সংখ্যা, ২০১৩ তে প্রকাশিত]

কিন্তু টেকটিউনসতে পূর্বে প্রকাশ হয়নি। তাই লেখকের অনুমতিক্রমে এখানে আর্টিকেলটিকে আরো একটু মোডিফাই করে এবং সাজিয়ে উপস্থাপন করা হলো। আশা করি এডমিন এটা ডিলিট করবেন না। ধন্যবাদ।
All credit goes to main author.

বিজ্ঞানের সাথে থাকুন, বিজ্ঞানকে ভালোবাসুন।


লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয়ঃ https://bigganbortika.org

বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয় নিয়ে চোখ রাখতে পড়ুন বিজ্ঞানবর্তিকা। 

Level 0

আমি কামরুজ্জামান ইমন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 9 বছর 7 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 33 টি টিউন ও 124 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 2 টিউনারকে ফলো করি।

বিজ্ঞানকে ভালবাসি। চাই দেশে বিজ্ঞান চর্চা হোক। দেশের ঘরে ঘরে যেন বিজ্ঞান চর্চা হয় সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

প্রিয় টিউনার,
আপনি আপনার টিউনটি http://www.bigganbangla.com/%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A1-%E0%A6%AE%E0%A6%A1%E0%A7%87%E0%A6%B2/#.VClAZBYpeZQ থেকে কপি পেষ্ট করছেন। তাই আপ্নারটিউনটি পেন্ডিং করা হল।