গ্যালাক্সী রানার [বি-কল্প গল্প]

মানুষ কখনো কল্পনাতেও ভাবেনি যে সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে অতি পুরানো একটি প্রথা জনপ্রিয় হবে। এটাও ভাবেনি যে এত পুরানো প্রথাটি ছাড়া সভ্যতা ত্বরান্বিত হবেনা। ৩২৪৭ সালে যখন ডেভিড হালম্যান টেলিপোর্টেশন বিজ্ঞানে প্রথমবারের মত পূর্ণভাবে সফল হলেন, তখন দেখা গেল আজব এক ঘটনা। সেটা হল টেলিপোর্টেশন করে কোন বস্তুকে স্থানান্তর করা সম্ভব হলেও অতিসাধারন আলোকে স্থানান্তর করা যাচ্ছেনা। একি আশ্চর্য! আলো তার নিজের ছন্দেই চলবে। ৪০৫০ সালে মহাশূণ্যে টেলিপোর্টেশন সম্ভব হল। গ্রাহক প্রান্তে কোন যন্ত্র ছাড়াই কাঙ্ক্ষিত স্থানাংকে চলে যেতে পারত কোন স্পেস হাইপার ডাইভিং ইঞ্জিন। কিন্তু এখানেও একই বিপত্তি, আলো মহাশয় যাবেনা। যে কারনে আন্তঃগ্যালাক্সীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারঙ্গিক মাধ্যম ছিল পুরোপুরিই অসহায়।

এখন ৪৫৫৩ সাল। মহাবিশ্ব অতি বড় জীবগোষ্ঠির বসবাসস্থল, একটি সমাজ। বহুজাতিক, বহুমাত্রিক ভাষা তবে অনুভূতির কোয়ান্টাম সিগনাল একই। কাজেই ভাব আদান প্রদান কোন বিষয়ই না। যে সমাজ গড়ে উঠেছে তার মধ্যকার সম্প্রীতি রক্ষার জন্য বাস্তবিক সম্পদ অথবা মেধাসম্পদ আদান প্রদান অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে। এই চাহিদা থেকেই উৎপত্তি ‘গ্যালাক্সী রানার’ এর। গ্যালাক্সী রানার হল আন্তঃগ্যালাক্সীয় পোস্টম্যান, যার ধারনাটা তৈরী হয়েছে প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বের ইতিহাস থেকে। তখন নাকি পৃথিবীর মধ্যেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কোন মালামাল বা চিঠি পাঠাতে হলে পোস্টম্যানরা নিজেরা বহন করে নিয়ে যেত! জজজ বা জগৎ জুড়ে জাল, পার্সোনাল টেলিপোর্টেশন উইন্ডো দুটির কোনটাই ছিলনা তখন।

গ্যালাক্সী রানারের জীবন বড় অদ্ভূত। যারা এ পেশায় আসে তারা সাধারনত চরম হাতাশাগ্রস্ত জীবন থেকে আসে। যার জীবনের উপর থেকে মায়া উঠে গেছে। ডাকবিভাগ তাদের তুলে এনে পুনর্বাসন করে। বিনিময় হিসেবে ডাকবিভাগ তাদের সমস্ত পরিবার পরিজনের ভরন-পোষনের দায়িত্ব নেয়। কারন গ্যালাক্সী রানার হওয়া আর জীবনটা উৎসর্গ করে দেয়া একই কথা বৈকি।

রেড্যালিন একজন গ্যালাক্সী রানার। রেড্যালিনের পরিবারের দায়িত্ব নেয়নি ডাকবিভাগ, কারন তার পরিবারই নেই। এতিম অবস্থায় বড় হয়েছে সে। জীবনে কিছু পাবার নেই তাই হতাশা থেকে চলে এসেছে গ্যালাক্সী রানার হতে। তার স্পেসশীপের নাম ‘ঈশান কুরিয়ার শীপ-২’। সে সাধারনত স্মার্মন গ্যালাক্সীপুঞ্জে ডাক পৌঁছায়। প্রতিটা যাত্রা মোটামুটি ০.৫১ নাক্ষত্রিক বছর সময় নিয়ে থাকে যা পৃথিবীর হিসেবে সাড়ে চারমাসের মত।

এ মূহুর্তে রেড্যালিন বসে আছে ঈশানের নেভিগেশন প্যানেলে, হাইপার স্পেস ডাইভিং প্রোটেকশন স্যুটে। এটা একটা কফিনের মত সাথে অনেক মনিটর আর কন্ট্রোল। ভেতরটায় শুধু নাকে অক্সিজেনের ব্যাবস্থা, আর বাকিটা ভ্যাকুয়াম। শরীরটা সেঁটে থাকে একটা সুঁচাল গদিতে। সুঁচগুলো আসলে স্নায়ু প্রশমিত করার জন্য ব্যবহার করা হয় যেন স্পেস ডাইভে শারীরিক প্রতিক্রিয়া যতটা সম্ভব কম হয়। উল্লেখ্য যে এই স্যুটটা শধুমাত্র ত্বরনের সময় ব্যবহার হয়। হাইপার ডাইভে চলে গেলে আর প্রয়োজন হয়না।

রেড্যালিন স্যুট থেকে নিষ্ক্রান্তি প্রক্রিয়া শেষ করে বেড়িয়ে এলো। এখনো অন্তত তিনমাস আছে যাত্রার। ক্যারিজে গিয়ে দেখতে হবে সমস্ত মালামাল আর চিঠির পেঁটরা হাইপার ডাইভের পর ঠিক আছে কিনা। সে লিস্টটা হাতে নিয়ে ক্যারিজের দিকে গেল।

সব ঠিক আছে। শুধু একটা ছয় ফুট দীর্ঘ বাক্সের ধাতব গা’টা ভেতর থেকে বাইরে দেবে গেছে। এমন হবার কথা না। খুঁটিয়ে দেখল রেড্যালিন। লিস্টের সাথে মিলিয়ে দেখল, বাক্সের ভেতর যন্ত্র থাকার কথা। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করল। সাধারন অক্সিজেন পাম্পের শব্দের মত শব্দ আসছে একটা। সে একটু ভাবতে চেষ্টা করল। কি থাকতে পারে এর ভেতরে। চলে আসবে এমন সময় হালকা একটা শব্দ আসল, উৎপত্তিস্থল মনে হল বাক্সের ভেতর থেকে।
আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল রেড্যালিন। সন্দেহজনক কিছুই নেই। কিন্তু তার ষষ্ঠেন্দ্রিয়ই মনে হয় তাড়া দিচ্ছিল। সে আন্তঃ গ্যালাক্সীয় সংবিধানের একটা ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিল। পরিস্থিতি যদিও উদয় হয়নি তারপরও গ্যালাক্সী রানারের প্রদত্ত ক্ষমতা অনুসারে সে এটা করতে পারে।

লেজার করাতটা নিয়ে এসে একে একে সিলগুলো কেটে ফেলল ধারাল রশ্মি দিয়ে। ভেতর থেকে নাইট্রোজেনের কোন ধোঁয়া বেড়িয়ে এল। পুরো ডালাটা খুলে ফেলতে ধোঁয়ায় সয়লাব হয়ে গেল, কিছু দেখা গেল না। একটু কেশে ধাতস্ত হয়ে যখন বাক্সের ভেতরে দেখল রেড্যালিনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল!

একটা জীবন্ত মেয়ে!

তরুণী, নগ্ন, দেহটা একপাশে ফিরে আছে, পেছনের পা সোজা আর উপরের পা’টা ভাঁজ করা। দুই হাত মুখের পাশে একসাথে করে রাখা, হাত-পায়ের কব্জিতে ধাতব বেল্ট দিয়ে আটকানো। তার মুখে, নাকে, নাভিতে নল লাগানো, সে দিয়ে তরল পদার্থ দেহের ভেতরে বাইরে আনাগোনা করছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। জেগে আছে মেয়েটা!
চোখে অন্ধকার দেখল রেড্যালিন। কি করবে সে। মেয়েটার চোখে ভয়ানক আকুতি – বাঁচার, একইসাথে ভয়ের। রেড্যালিন কোনমেতে মেয়েটার জীবনরক্ষী সিস্টেমটা অকেজো করে কোলে করে নিয়ে আসল ঈশানের নেভিগেশন প্যানেলে। তারাতাড়ি হাইপার ডাইভ স্যুটে জায়গা দিল সে। তারপর সচল করে দিল স্যুটটা। নিশ্চয়ই হাইপার-ডাইভের সময় মেয়েটার উপর দিয়ে অমানুষিক ধকল গেছে, তাই জেগে উঠেছে শীতল বাক্স থেকে।

পুরো দুই দিন স্যুটে রেখে পর্যবেক্ষন করল রেড্যালিন। মেয়েটার শরীরবৃত্তীয় কাজকর্ম স্বাভাবিক হয়ে আসছে। কয়েকঘন্টার মধ্যেই জাগিয়ে তোলা যায়। এমন সময় ভাবল প্রচন্ড ক্রোধের সাথে কে এই অসভ্য যে গ্যালক্সী কুরিয়ারে অবৈধ জিনিস পাঠিয়েছে। ডাকবিভাগের উপরও একটা অভক্তি আসল তার, কেউ নিরীক্ষা না করেই বাক্সটা কুরিয়ার শীপে উঠিয়ে দিল! ঘেঁটে দেখল জোনান শেরনীল নামের এক ব্যাবসায়ী পোস্ট করেছেন বাক্সটা, গন্তব্য ভার্সেইয়াস গ্রহের কৃণতিন মোরুফ নামের আরেক ভদ্রলোক ব্যাবসায়ীর কাছে। ‘শালার এই দুটোকে যদি আমি না খেয়েছি...’ দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করল রেড্যালিন। কেন একটা জলজ্যান্ত মেয়েকে পোস্ট করা হল সে সম্পর্কে অন্ধকারেই থেকে গেল অবশ্য।

মেয়েটাকে না জাগিয়ে ঘুমন্ত অবস্থাতেই স্যুট থেকে বের করল সে। নিজের পুরনো কিছু কাপড় দিয়ে নগ্ন দেহটা ঢাকল। নিতান্তই কাঁচা তরুণী, দেহে যান্ত্রিকতার অত্যাচারের ক্লান্তির ছাপ ছাড়া কোন অসৌন্দর্য নেই, মেয়েলী মহিমারও কমতি নেই।

পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে মেয়েটা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। রেড্যালিন ছুটে আসায় তাকে দেখে আরো আতঙ্কিত হল। বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করল মেয়েটাকে। কান্না শুরু করল তরুনী। ফোঁপাতে ফোঁপাতে যা বলল তার সার সংক্ষেপ এই – তরুণীর নাম নীরা। সে কৃত্রিমভাবে জন্ম নেয়ে একটা মেয়ে। উল্লেখ্য যে কৃত্রিমভাবে জন্ম দেয়ার প্রথা পুরো বিশ্বময় উঠে গেছে, এটা রীতিমত অবৈধ। তবুও কিছু কিছু অসাধু মেডিকেল সেন্টার এটা করে থাকে অনেক টাকার বিনিময়ে গোপনে বড়লোক নিঃসন্তান দম্পতিদের দিতে। নীরা তার জন্মকথা জেনে ফেলে এবং খুব কষ্ট পাবার পর শক্তি সঞ্চয় করে গণমাধ্যমে জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়; তাতে যদি অন্তত ভবিষ্যতে তার মত আর দূর্ভাগার জন্ম না হয়। কিন্তু তার আগেই তার পিতা মানে দত্তক পিতা তাকে কুরিয়ার করে দেয়।

রেড্যালিন কোন স্বান্তনা দিলনা তরূনীকে। আসলে দেয়ার মত কিছু নেইও। এখন সে চিন্তা করছে অন্য কথা। ঈশানকে বানানো হয়েছে একজন গ্যালাক্সীয় রানার থাকার উপযোগী করে। সমস্ত রসদও একজনের জন্য, যদিও অতিরিক্ত অনেক আছে। খুলে বলল সে মেয়েটাকে। নীরা নিশ্চুপ রইল; হয়তো নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর কারনে কৃতজ্ঞতাস্বরুপ আর কিছু চাওয়ার নেই তার।

“তুমি আমার ঘরে থাক, আমি কোন চেয়ারে কিংবা হাইপার ডাইভ স্যুটে ঘুমিয়ে নেব”। বলল রেড্যালিন। উত্তরে নীরা শুধু একমুহূর্ত বেশী তাকিয়ে থাকল বক্তার দিকে। কয়েকটা পার্থিব দিন গেল ঈশানে এই নিয়মে। রেড্যালিনের ক্লান্তির পরিমান বেড়ে যায় এভাবে, কারন নিজের ঘরটা ছাড়া অন্য ঘর বা নেভিগেশন রুম ঘুমানোর উপযোগী করে বানানো হয়নি। একটা বিজ বিজ শব্দ থাকে এবং সবসময় আলো থাকে। নীরা রেড্যালিনের চেহারা দেখে বুঝল। কাজেই তাকে প্রস্তাব দিল ওর নিজের ঘরে পুনরায় থাকতে, সে নিজেই বরং কোন চেয়ারে ঘুমাবে। রেড্যালিন রাজী হলনা। “তাহলে আমার সাথে একসাথেই থাক তুমি...” বলে ফেলল নীরা।

কিছু কথা-বার্তার পর তাতে রাজী হতে হল রেড্যালিনের। সেদিন শুতে শুতে তার শরীর খারাপ হয়ে গেল। গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। নীরা রেড্যালিনকে ধরে ধরে শুইয়ে দেয়। পাশে পাশে বসে থাকে, মাথা টিপে দেয়, খাবার খাইয়ে দেয় এবং ঈশানের যাবতীয় নিয়মিত কাজগুলো ওর কাছ থেকে শুনে শুনে করে দেয়।
গ্যালাক্সী রানারের অবশ্য তাতে আরোগ্য হচ্ছিলনা। ক্রমেই আরো রোগাটে হয়ে যাচ্ছিল। ঈশানের কম্পিউটারে থাকা চিকিৎসা সহায়িকা ঘেঁটে সব কিছুই কররেছে নীরা, তবুও কাজ হচ্ছেনা। যেদিন রেড্যালিন প্রচন্ড জ্বরে প্রলাপ বকতে শুরু করল সেদিন ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করল।

কোন এক সন্ধ্যা ঈশানে। রেড্যালিনের ঘুম ভেঙে যায়, তার বুকের উপর নীরা মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটা তার পাশে বসে ছিল, ক্লান্তির কারনে কখন ঘুমিয়ে গেছে! জাগালনা তার ঘুম, এখন নিজেকেও একটু সুস্থ মনে হচ্ছে। ডান হাতটা মুক্ত করে মাথার উপর কম্পিউটার স্ক্রীণে ঈশানের বিভিন্ন অবস্থা দেখল। মোটামুটি স্বাভাবিক আছে। তার কৃতিত্ত্বটা অবশ্য নীরার। মেয়েটার অনেক খাটতে হয়েছে। একটু আদর অনুভব করল সে নীরার জন্য। আবার পরমুহূর্তে বিপরীতার্থক অনুভূতি দিয়ে ভাসিয়েও দিল। কি মনে করে কম্পিউটারে একটা বায়ো-সিগনেচার স্ক্যান দিল সে। কিছুক্ষন পরই প্রতিবেদন পর্দায় ভেসে উঠে। তাতে দুটি মাত্রা বেশী দেখে বুঝতে পারে যে এই দুটো সে নিজে এবং নীরা। কিন্তু তারপরও আরো অসংখ্য ছোট ছোট বায়ো সিগনেচার আসে, এগুলো অস্বাভাবিক। এগুলো কখনো থাকেনা। কোত্থেকে আসল ভেবে পেলনা সে। অবশেষে এগুলোর প্রতিকার করার নির্দেশ দিল কম্পিউটারকে।
নীরার ঘুম ভাঙে। লজ্জা পেয়ে সরাৎ করে সরে যায়।

“তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,” অস্ফুটে বলল রেড্যালিন, “আমার সেবা করার জন্য...”।
“আমি অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম তোমার অবস্থা দেখে। এখন কেমন লাগছে?”
“অনেকটা ভাল”।

এরপর টুকটাক আরো কথা হল। কিন্তু অতিরিক্ত বায়ো সিগনেচার যে পাওয়া গেছে সেটা জানালনা।
মহাকাশযান ঈশানে পৃথিবীর আদলে তৈরী ক্রৃত্রিম দিন-রাত্রি অতিবাহিত হয়। রেড্যালিন বেশীর ভাগ সময় ঘুমিয়ে থাকে নয়তো শুয়ে থাকে, আর নীরা পাশে বসে থাকে। সে রেড্যালিনের কয়েকটা কাপড় নিয়ে কেটে ছেঁটে নিজের উপযোগী করে বানায়, নিজেই সেলাই করে। কিন্তু অসুস্থ মানুষটার পাশ ছাড়েনা। ঈশানে পৃথিবীর যে সুন্দর সুন্দর ছবিগুলো গ্যালাক্সী রানারের নিঃসঙ্গতার উপকরন হিসেবে দেখানো হয়, সেগুলো সত্যি মনলোভা; কিন্তু নীরার বুকে হাহাকার করে উঠে। মনে হয় ছবিগুলোতে একটা জিনিসই কেবল নেই, মানুষের সুখের ছবি। আহা! সেখানে যদি দুটি মানুষ থাকত, যার মধ্যে একজন সে নিজেই, আরেকজন যাকে সে ভালবাসে। সে থেকেই হয়তো মনে একটা টানের সৃষ্টি হল নিঃসঙ্গ এই গ্যালাক্সী রানারের প্রতি, সেও তো তার মতই নিঃসঙ্গ।

রেড্যালিন এখন ধরে ধরে হাঁটতে পারে। একদিন সুস্থ বোধ করায় হাঁটছিল। ঘুরে দেখতে দেখতে সে অবাক হয়ে যায়। একটা মেয়েলী হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঈশান কারুময় হয়ে উঠেছে। এক জায়গার জিনিস আরেক জায়গায় পড়ে নেই, প্রতিটা জিনিস গোছানো। ঈশানকে এখন সারারাতের শিশিরভেজা একটা ফুলের মত লাগছে, ছুঁয়ে দিলেই যেন মলিন হয়ে যাবে।

যাত্রা শেষ হতে এখনো ৭৯ দিনের মত বাকি। বায়ো-সিগনেচার আরো বাড়ছে। কোন ধরনের ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া তো মাত্রাতিরিক্ত বাড়ার কথা না! নেভিগেশন রুমে বসে রেড্যালিন আরো কয়েকটা কাজ সেরে নিল। খাবার নিয়ে এলো নীরা। সাধারনত রেড্যালিন এমন খাবার তৈরী করেনা তাই খাওয়াও হয়না, ঝটপটের উপর দিয়ে সারে।

বিগত কয়েকটা দিনের কথা ভাবে রেড্যালিন। অন্য চোখে দেখতে শুরু করে নীরাকে। এই যে মেয়েটা হাঁটে, যেন একটা তরঙ্গ অবিরক্ত অবস্থায় ভেসে যাচ্ছে, পানিতে জলকেলি করে এমন কোন পাখির নির্ভুল বেয়ে যাবার মত। এখানে কোন বাতাসের প্রবাহ নেই, কিন্তু তার চুলগুলো ঝাঁকুনিতে উড়াউড়ি করলে মনে হয় একটু বাতাস ভালবেসে ভারী হয়ে সে ঘটনাকে সহযোগিতা করে। গান শোনা হয়না বহুদিন, নীরার তীক্ষ্ণ কন্ঠের কথায় গান হয়ে বাজে। দূর্বল হয়ে যাচ্ছে রেড...

রেড নামটা নীরার দেয়া। ডাকার সুবিধার জন্য সে ছোট করে নিয়েছে। ওর জামাগুলো কেটে নিজের জন্য বানিয়েছে... নিশ্চিন্ত মনে এতোগুলো অধিকার দেখানো নিতান্তই স্পর্ধা; কিন্তু কিছু বলতে পারেনা রেড। ঈষান তার জীবনে নমনীয়তার একটা কারন, আর সম্পূর্ণ গলে যাওয়ার কারন এখন নীরা।

রেড ঠিক করল, খুব শীঘ্র সে নীরাকে ভালবাসার কথা বলবে।

কিন্তু সেদিনই নীরা অসুখে পড়ল। একই অসুখ কিন্তু মনে হচ্ছে নীরার বেলায় রেডের চেয়ে মারাত্নক। রেড প্রতিদানের নিমিত্তে শশ্রুষা করতে শুরু করল, এবং ক্রমে গভীর থেকে গভীরে ভালাবাসায় পড়তে লাগল। ভালবাসা দিয়ে সম্ভবত রোগমুক্তি হয়না। কাজেই যখন নীরা প্রচন্ড রকম অসুখে পড়ে গেল, রেড তাকে কোলে তুলে নিল ক্লোজ বায়ো-সিগনেচার যন্ত্রে পরীক্ষা করার জন্য। এটাই সর্বশেষ ধাপ ঈশানে রোগনির্নয় বা সুস্থ করার জন্য।
ক্লোজ বায়ো সিগনেচারে খুব কাছ থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী বিকিরন দ্বারা শরীর স্ক্যান করা হয়। এতে শরীরের পরজীবী ছাড়াও অভ্যন্তরের সমস্ত কিছু ধরা পড়ে। রেড রিপোর্টটা স্ক্রীণে দেখে দশ মিনিট হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।
নীরার সারা শরীরে পরজীবীর ছাপ স্ক্রীণের রঙটা বেগুণী করে রেখেছে। বিপজ্জনক মাত্রারও উপরে। তাড়াতাড়ি ঘেঁটে দেখল সহায়িকা। কি! এর কোন প্রতিকার নেই? নীরার মুখের শিরা-উপশিরাগুলো দেখা যাচ্ছে, নীলচে হয়ে ভেসে উঠছে। ভেতর থেকে স্পন্দিত হল রেড। তাড়া দিল কেউ কিছু করার যেন এই মেয়েটাই তার অবলম্বন হয়। ভেজা ভেজা চোখের কোনায় একফোঁটা অবাধ্য অশ্রু নিয়ে সে পরজীবি গুলো মারার আদেশ দিল, এখন আরেকটা বিকিরন শরীরের ভেতর দিয়ে যাবে। পরজীবি গুলো মারার সাথে সাথে নীরাও একটু দূর্বল হবে। একজন মানুষের জীবনে এই বিকিরন সর্বোচ্চ তিনবার ব্যবহার করা যায়।

মুখ তুলে স্ক্রীণে তাকাল রেড। বেগুণী গুলো কমে গেছে, কয়েক জায়গায় লাল হয়েছে, কয়েক জায়গায় হলুদ। পুরোপুরি বিনাশ হলে কোন রঙ থাকার কথা না, শুধু কয়েক জায়গায় সবুজাভ থাকবে। এবার রেডের চোখ দিয়ে পানি গড়াল, আর কেবল ভিজে নেই। চিন্তা করছে আরেকবার দেবে কিনা। ভাবতে ভাবতে সে খেয়াল করল হলুদগুলো ক্রমে লাল হচ্ছে আর লাল গুলো বেগুণী। নিরুপায় রেড ডুকরে উঠে মেঝেতে বসে পড়ল।

নীরা কি একটু ডাকল? যান্ত্রিক ক্রিরররররর শব্দের সাথে মিশে গেল নাকি? রেড তাকাল যন্তের নিচে শুয়ে থাকা মানবীর দিকে। ঠোঁটটা মনে হয় একটু তির তির করছে। ঝটকায় উঠে কাছে গেল নীরার।
“আমার কি হয়েছে?” অস্পষ্ট, প্রায় শোনা যায়না।

“কিছু হয়নি তোমার। তুমি ভাল হয়ে যাবে”।
“আমি জানি। আমি আর ভাল হবনা”, একটু বিরতি নিল, “জানো, আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি...”
রেডের চোখের বানে প্রমত্তা ঢেউ আঘাত হানল। হাত চেপে ধরল নীরার। “আমিও..., তোমার কিচ্ছু হবেনা নীরা...” নিজের কাছেই হাস্যকর ঠেকল কথাটা।
“তুমি যতদিন অসুস্থ ছিলে, তোমার কম্পিউটারে সব সুন্দর সুন্দর দৃশ্যের ছবিগুলোতে আমি তোমাকে নিয়ে কল্পনা করেছি।” কাশল একটু, “আমি মরে যাচ্ছি। আমার মরতে ইচ্ছে করছেনা।”

কথাটা মূর্তি করে দিল রেডকে। মানুষের কাছে আকাঙ্ক্ষার মানুষ যদি এমন কিছু চায় যা কখনোই দেয়া একটা ম্নুষের পক্ষে সম্ভব নয়, এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটতে পারেনা। রেড চোখের পানি মুছে ধীরে ধীরে নীরার পাশে উঠল। নীরার মাথাটা তার বাহুতে রেখে শুয়ে পড়ল মেয়েটার পাশে। স্নেহের আলিঙ্গনে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। নীরার প্রাণ বেড়িয়ে যাচ্ছে খুব ধীরে, অসাড় হয়ে যাচ্ছে সে। অনেক কথা ঘুরপাক খাচ্ছে তার চেহারায়, কিন্তু বলার শক্তি পাচ্ছেনা। রেড আলিঙ্গনটা একটু শক্ত করল তার কথাগুলো বুঝতে পারছে বোঝাতে। নীরার একটা হাত রেডের বুকে। হাতের চাপটা ক্রমশই কমে যাচ্ছে।

শুয়ে থেকেও যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে হাত যায়। রেড পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত পরজীবি নিধক বিকিরন চালিয়ে দিয়ে নীরাকে ধরে নীরব হয়ে গেল...

পৃথিবীতে।
পার্থিব সেনাবাহিনী সদর দপ্তর। এখনো কর্মব্যাস্ততা শুরু হয়নি। সেনাপ্রধান এখনো অফিসে আসেননি। তার টেবিলে একটা চিঠি অপেক্ষা করছে। তিনি এলে খুলে দেখবেন-

বরাবর
সেনাপ্রধান
পার্থিব সেনাবাহিনী

সংশ্লিষ্ট সূত্র মোতাবেক জানানো যাচ্ছে যে, পার্থিব সেনাবাহিনী এবং প্রাণ রসায়ন একাডেমীর যৌথ গোপনীয় প্রজেক্ট ‘গ্যালাক্সী রানার মানবী’ বিশ্বব্যাপী ব্যার্থ হয়েছে। প্রাণ রসায়ন একাডেমী এযাবৎ কালের সবচে মারাত্নক জীবাণু একটি কৃত্রিম তরুণীর শরীরে নিখুঁতভাবে সংযোজন করতে সক্ষম হয়। সেনাবাহিনীর ভ্রান্তিহীন তৎপরতায় সেটি পরিকল্পনামাফিক স্মার্মন গ্যালক্সীপুঞ্জের কুরিয়ার শীপে উঠিয়ে দেয়া হয়। সর্বশেষ পাওয়া প্রতিবেদনে জানা যায়, স্মার্মন গ্যালাক্সীপুঞ্জের কোন গ্রহে সেই জীবাণুর কোন আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়নি। ডাকবিভাগের প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে স্মার্মন গ্যালাক্সীপুঞ্জের উদ্দেশ্যে গমনকৃত কুরিয়ারশীপ ঈশান-২ অজানা কারনে গন্তব্যে পৌঁছায়নি। নতুন কোন তথ্য পাওয়া মাত্র এই ইউনিট সদর দপ্তরকে অবহিত করবে।

দায়িত্বরত অফিসার
স্মার্মন নিধন প্রকল্প

তৌহিদুর রহমান
http://about.me/tanimkg

Level 0

আমি তৌহিদুর রহমান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 5 টি টিউন ও 23 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

ধন্যবাদ

Level 0

দারুন!

nice হইছে 🙂