রিভলবার :: ভেতরের কারিগরী ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

সন ১৮৩০; স্যামুয়েল কোল্ট নামের বছর ১৬র এক ছোকরা বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছাড়ল | ভাগ্যসন্ধানের জন্য চড়ে বসলো ভারতবর্ষগামী এক বানিজ্য জাহাজে | জাহাজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়ে খেলাচ্ছলে বানিয়ে ফেলল এক নতুন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র - যেটা বার বার লোড না করেই গুলি ছোঁড়া যায় পরপর | অবশ্য, এর আগেই এই রকমের কারিগরীওয়ালা আগ্নেয়াস্ত্র বেরিয়ে গেছে বাজারে; কিন্তু কোনটাই তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি | কেননা, আগেরগুলো ছিল যথেষ্ট জটিল এবং ব্যবহার করাটা ছিল রীতিমত একটা ঝকমারি ব্যাপার |

জাহাজের ক্যাপস্টান এর কারিগরী কৌশল থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে কোল্ট তৈরী করেন অত্যন্ত সরল একটা রিভলভিং এমুনিশন সিলিন্ডার | সেই সিলিন্ডার এর মেকানিজম ব্যবহার করে তিনিই প্রথম তৈরী করলেন রিভলবার | কোল্ট এরপর স্থাপন করেন রিভলবার এর কারখানা | শুরুর দিকে, এটিও বাজারে পাত্তা পায়নি এর পূর্বসুরীদের মতই | ১৮৫০ এর দিকে প্রথম কোল্ট এর কারখানা অভূতপূর্ব সাফল্য পেতে শুরু করে | ১৯৫৬ সাল নাগাদ, কোল্ট এর রিভলবার এত্তই জনপ্রিয়তা পায় যে ওই সময় ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে পাল্লা দেয়ার জন্য তার কারখানা দিনে ১৫০ এর বেশি রিভলবার তৈরী করতে শুরু করে |
কারিগরী দিক থেকে ভীষনরকম সরল এই যন্ত্রটি প্রথমে আমেরিকা এবং পরে সাড়া পৃথিবীর মানুষের জীবনধারাই পাল্টে দেয় | শুনতে নিষ্ঠুর হলেও ভীষণ বাস্তব এই সত্য যে , মুঠোভর্তি মাত্র এই অস্ত্র যত সহজে মুহুর্তের মধ্যে মেরে ফেলতে পারে একটা প্রানীকে, এত সহজ খুন করার যন্ত্র ছিলনা আগে মানুষের হাতে |

আসুন, আজকে খুব সহজভাবে বোঝার চেষ্টা করি যে কিভাবে কাজ করে এই আগ্নেয়াস্ত্রটি; যে কিনা আবিস্কার এর ১৮০ বছর পরেও সমান জনপ্রিয় এবং কার্যকর | এটা জানার জন্য আগে একটু জানতে হবে যে যেকোনো আগ্নেয়াস্ত্রর বেসিক কার্যপদ্ধতি কি | চলুন, শুরু করা যাক |


আগ্নেয়াস্ত্রের মূলনীতি এবং সংক্ষিপ্ত ইতিহাস


প্রায় সমস্ত ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রই একটি সাধারণ নীতির ওপর নির্ভর করে কাজ করে: যে জিনিসটাকে নিক্ষেপ করা হবে - যে জিনিসটাকে চলতি কথায় গুলি বা গোলা বলি - সেটাকে একটা এমন মাপের সিলিন্ডার-আকৃতির একটা ধাতব চোঙ এ ভরা হয় যাতে ওই গোলাটা খাপে খাপে এঁটে যায় ওটার ভেতরে | সিলিন্ডারের একদিক খোলা থাকে গোলা বেরোবার জন্য | এবার কোনো বিস্ফোরক ব্যবহার করে ওই গোলার পেছনে চাপ তৈরী করা হয় যাতে ওটা ছিটকে বেরিয়ে যায় চোঙ থেকে |
কামান :-

এই মূলনীতির সবচেয়ে সরল এবং আদি প্রয়োগ হচ্ছে কামান | কামানের মূল অংশটা হলো একটা ধাতব শক্ত টিউব যার একদিক খোলা এবং অন্যদিক বদ্ধ | বন্ধ দিকে একটা ছোট্ট ছিদ্র থাকে আগুন ঢোকানোর জন্য, যেটাকে ফিউজ হোল বলে | এবার ওই ধাতব টিউবের ভেতরে ঠুসে ঠুসে ভরা হয় চারকোল, সালফার আর পটাসিয়াম নাইট্রেট এর মিশ্রণ; যাকে চলতি ভাষায় আমরা বলি বারুদ | চেপে চুপে ওই বারুদ ঢুকিয়ে দেয়া হয় টিউবের বন্ধ প্রান্তের শেষে | তারপর এর ওপর ভরা হয় কামানের গোলা | এদিকে ফিউজ হোল দিয়ে আগে থেকেই ঢোকানো থাকে দাহ্য পদার্থ মাখানো সলতা; যাকে ইংরেজিতে বলে ফিউজ | এটা ঢুকে থাকে বারুদের ভেতরে | এবার কামান মারতে গেলে আগুন লাগানো হয় ফিউজে | আগুন সেই সলতা বেয়ে পৌছায় বারুদে | যেইনা বারুদে আগুন ধরে অমনি অত্যন্ত দ্রুত পুড়তে থাকে বারুদ আর তৈরী হয় গরম গ্যাস | পদার্থবিদ্যার সূত্রানুযায়ী এই গ্যাস ওই আবদ্ধ জায়গার ওপর প্রচন্ড চাপ দেয় | টিউবের খোলা দিক ছাড়া আর কোনো দিকে আলগা জায়গা না পেয়ে সেই চাপ খুব জোর ঠেলা মারে গোলাটা কে সেই খোলা জায়গার দিকে | সমস্ত ঘটনাটা ঘটে চোখের পলকে; তাই প্রচন্ড আওয়াজ আর আগুনের হলকার সাথে প্রচন্ড গতিবেগে বেরিয়ে আসে গোলাটা | এইভাবে কামান নিক্ষেপের দৃশ্য আমরা অনেক দেখেছি ছায়াছবি বা সিরিয়ালে |

প্রথমদিকের হাতে ধরে ব্যবহার করার মত আগ্নেয়াস্ত্রগুলো আসলে ছিল কামানেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ | সেই ঠুসে ঠুসে বারুদ ভরো, ছোট্ট গুলি ভরো, আগুন লাগাও আর সই করে ধর লক্ষের দিকে | এটা ঠিক যে কামানে যেরকম পেছন থেকে আলাদা করে আগুন লাগানো হত, এইসব আদি পিস্তলে কিন্তু ট্রিগার টানার সাথেই আগুন তৈরী করার ব্যবস্থা থাকত | এরকমই দুটি উল্লেখযোগ্য আদি পিস্তল হলো percussion cap gun আর flintlock gun |

Hand - Cannon:-

percussion cap gun আর flintlock gun যথেষ্ঠ আধুনিক জিনিস | flintlock gun কে আধুনিক পিস্তল / রিভলবার এর ভিত বলা হয় | কিন্তু একদম শুরুর দিকে এত আরামের জিনিস ছিলনা |
একদম প্রথমে এইরকম হাতে ধরে গুলি ছোঁড়ার মত যে জিনিসটা ব্যবহার হত সেটা হলো hand - cannon | ১৪০০ সালের দিকে এটা বেশ ভালই ব্যবহার হত | এটা প্রকৃতিগতভাবে কামানই ছিল; শুধু আকারটা ছোট করে ফেলা হয়েছিল যাতে মানুষ হাতে নিয়েই ব্যবহার করতে পারে | মজার ব্যাপার হলো, ৪ নল ওয়ালা hand - cannon এরও চল ছিল | একসাথে ৪ টা নলই ভরা থাকত গোলাবারুদে | এরপর শুধু আগুন লাগাও আর চালাও ! বোঝাই যাচ্ছে, শুরু থেকেই মানুষের মাথায় ছিল কম সময়ে বেশি খুনের ধান্দা ! ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ওই সময় লোকেরা এটা ব্যবহার করত ঠিকই কিন্তু মনে মনে চাইছিল যাতে এটার আকার আরো ছোট হোক আর বারুদে সরাসরি আগুন না লাগিয়ে এরকম একটা ব্যবস্থা হোক যাতে গুলি ছোঁড়ার সময় এ আপনা থেকেই বারুদে আগুন লেগে যায় |

Matchlock পিস্তল :-

এই প্রয়োজন থেকেই এলো lock system : বারুদে যথাসময়ে আগুন লাগানোর বাহ্যিক ব্যবস্থা | flintlock এর আগের অনেক অস্ত্রেই এই ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হয়েছে|matchlock হলো এরকম একটা হাতে ধরা অস্ত্র | এটাতে একটা দড়ি লাগানো থাকত, যেটা জ্বলত খুব ধীরে ধীরে | দড়িটাতে আগুন লাগানো হত দরকারের কিছুক্ষণ আগেই | আর দড়িটার আরেক মাথা বিশেষভাবে লাগানো থাকত একটা একটা লিভারে; যে লিভারটা হাতের আঙ্গুল দিয়ে সহজেই নাড়ানো যেত | এবার দরকারের সময় দড়িটাতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হত | দড়িটা জ্বলতে থাকত ধীরে ধীরে | একদম মোক্ষম মুহুর্তে আঙ্গুলের চাপে লিভারটা নাড়িয়ে দিলেই ওর সাথে সংযুক্ত জ্বলন্ত দড়িটা বারুদের সংস্পর্শে আসতো | ব্যাসস, কাজ শুরু বা কাজ শেষ ! এই লিভারটাকেই বলা যেতে পারে প্রথম ট্রিগার |
কিন্তু স্বভাবতই matchlock এর ছিল বেশ কিছু বড় ত্রুটি |
- আগে থেকেই দড়ি জ্বালিয়ে রাখতে হবে |
- লিভার টানতে দেরী করলে জ্বলে জ্বলে শেষ হয়ে যাবে দড়িটা |
- কোনো কারণে দড়িটা খুলে গেলে জিনিসটা দিয়ে বাড়ি মারা ছাড়া আর কোনো কাজে আসবেনা |
- দড়িটা ভিজে গেলেও অস্ত্র অকেজো |
এসব হাজার সমস্যা সত্বেও প্রায় ২০০ বছর ধরে matchlock চলেছে কারণ আর কোনো উপায় ছিলনা বলে | ওই ভারী হ্যান্ড ক্যাননে সরাসরি বারুদে আগুন লাগানোর থেকে তো অন্তত ভালো এটা ! আর সস্তাও ছিল |

Flintlock পিস্তল:-
কিন্তু লোকের মনে মনে এটা চলছিলই যে এমন একটা ব্যবস্থা হোক পিস্তলে যাতে ঠিক গুলির মুহুর্তেই আগুন ধরে বারুদে আর যেন আবহাওয়ার প্রভাব থেকেও মুক্ত থাকে; সর্বোপরি দামেও সস্তা হোক | এইসব চাহিদা পূরণ করেই বাজারে এলো flintlock পিস্তল আর শুরু করলো পিস্তলের আধুনিক যুগের সূচনা |

flintlock এর কারিগরী খুব সরলভাবে বলতে গেলে এইরকম: যেই মুহুর্তে trigger টানা হয়, flint টা গিয়ে আছড়ে পড়ে frizzen এর গায়ে আর আঁচড় কেটে নেমে যায় নিচের দিকে; ওই আঁচড় এর ফলে তৈরী হয় আগুনের ফুলকি | একই সময়ে flint এর ধাক্কা খেয়ে frizzen টা পেছনে হেলে গিয়ে উন্মুক্ত হয় pan টা, আগুনের ফুলকি গিয়ে পড়ে pan এ রাখা অল্প বারুদে | সেই বারুদ মুহুর্তের মধ্যে জ্বলে গিয়ে ঢুকে পড়ে নলের ভেতরে আর জ্বালিয়ে দেয় নলের ভেতরের আসল বারুদে | তারপরেই গুড়ুম !!!!!

পিস্তল আর রিভলবারের পার্থক্য কি :-

এই লেখাতে এই পযন্ত দুটো আলাদা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে - রিভলবার এবং পিস্তল | খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে এই দুটো আবার আলাদা আলাদা করে কি বোঝায় | বেমিল বলার আগে আগে জেনে নেই যে এদের মিল কি | যেসব আগ্নেয়াস্ত্র এক হাতে ধরে গুলি ছোঁড়া যায়, এক কথায় তাদেরই পিস্তল বা রিভলবার বলা যাবে (পরিস্থিতির প্রয়োজনে কেউ যদি বড় বড় আগ্নেয়াস্ত্র এক হাতে ধরে চালায় সেটাকে যে এই ক্যাটাগরিতে ফেলা যাবেনা সেটা বলাই বাহুল্য) | পিস্তল হচ্ছে বেশি আদি জিনিস, অর্থাৎ বিস্ফোরণের ধাক্কা ব্যবহার করে কোনো জিনিসকে জোরে নিক্ষেপ করা হবে প্রাণী হত্যার জন্য; এই প্রয়োজনকে সফল করার চেষ্টার প্রথম ফসল হচ্ছে পিস্তল | আদি পিস্তল গুলোতে একবারে মাত্র একটাই গুলি ছোঁড়া যেত | সেই দিয়েই মানুষ পরমানন্দে খুনাখুনি চালাতে চালাতে অনুভব করলো বার বার বারুদ ভরো, গুলি ভরো, তারপর মারো; এই প্রক্রিয়াটা অনেক সময়সাপেক্ষ | আরো তাড়াতাড়ি মারতে পারলে সুবিধা | সেই প্রচেষ্টার ফলেই এলো রিভলবার | একবারে ৬ টা গুলি ভরে নিয়ে খুনোখুনি করায় সুবিধা হলো আরো বেশি | এখন অবশ্য পিস্তলের ক্ষমতা অনেক বেশি | গুলির আলাদা বাক্স বা ম্যাগাজিন ব্যবহার করে এর খুনি ক্ষমতা অনেকগুণ বাড়ানো হয়েছে | কিন্তু রিভলবার এর সাথে এর পার্থক্য হলো প্রকৌশলগত দিকে | রিভলবার এ গুলিগুলো যে ধাতব চেম্বার এ ভরা থাকে; সেটা relove করে, অর্থাৎ পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে ঘুরে আসে | ঘুরে ঘুরে আসার ফলে গুলিগুলো অস্ত্রের নলের সাথে এক লাইনে চলে আসতে থাকে পর পর | পিস্তলে এরকম revolving কোনো অংশ থাকেনা |
প্রথম দিকের রিভলবারে সেই পুরানো দিনের পিস্তলের মতই ঠুসে ঠুসে নলের ভেতর বারুদ ভরতে হত; সেই একইরকমভাবে বারুদের ভেতর ছোট্ট ছোট্ট গোল গোল গুলি ভরতে হত ; আর সেই নলের পেছনদিকে গুঁতা মেরে বারুদটা জ্বালানোর ব্যবস্থা থাকত | পার্থক্য একটাই, পুরানো পিস্তলে এই ব্যবস্থাটা একটা নলের জন্য করতে হত আর রিভলবারে ৬ টা আলাদা নলের ভেতর এই কেরামতি করতে হত | একবার শুধু খাটুনি করে ৬ টা নলের ভেতরে গুলি-বারুদ ঢুকিয়ে নেওয়া; তারপরই আসল মজা | মারামারির সময় পরপর ৬ টা গুলি মারার ব্যবস্থা পাক্কা | নলগুলো ঘুরে ঘুরে আসবে আর গুলি বেরোবে |
বুলেট কার্ট্রিজ :-

মানুষের তো চাহিদার শেষ নেই | যখন ৬ টা গুলি একবারে মারার ব্যবস্থা হলো; তখন ভাবলো ইসস, এইভাবে সাথে বারুদ-গুলি আলাদা করে নিয়ে ঘর অনেক ঝামেলা | নলের ভেতর বার বার ভরতে হয় আলদা করে বারুদ আর গুলি; ভিজে যেতে পারে বারুদ কিংবা ঠিক মত ভরা না হলে misfire হবার সম্ভাবনা | কোনো ভালো ব্যবস্থা কি হয়না?
এই চাহিদা থেকেই ১৮৭০ এর দিকে এলো bullet cartridge | আলাদা করে নলের ভেতরে বারুদ-গুলি ভরার ঝামেলা থেকে মুক্ত হলো মানুষ | গুলি,বারুদ আর বারুদ জ্বালানোর জন্য প্রাথমিক প্রজ্জলক cap ; এদের একসাথে বিশেষ পদ্ধতিতে ভরা হলো একটা ধাতব খোলকের মধ্যে | এই জিনিসটাকেই বলা হয় বুলেট কার্ট্রিজ | সেই থেকে রিভলবার সম্পূর্ণতা পেল | প্রানিহত্যার এই আদিম যন্ত্রটি এরপর থেকে আর খুব একটা পাল্টায়নি |

রিভলবারের মূল কার্যপদ্ধতি :-

খুব সরল কারিগরির এই যন্ত্রটির মেকানিজম মোটামুটি এইরকম: ৬ টা চেম্বারের ভেতরে ৬ টা বুলেট কার্ট্রিজ ভরা হয় | রিভলবারের ট্রিগার টানার সাথে সাথে এই চেম্বারগুলো নল অর্থাৎ ব্যারেল এর সাথে একলাইনে চলে আসতে থাকে পর পর | যখনি কোনো চেম্বার বুলেট কার্ট্রিজ সহ নল বরারবর আসে, ঠিক তখনি একটা তীক্ষ্ণ hammer আছড়ে পড়ে কার্ট্রিজের পেছনে cap / primer এর ওপর | প্রাইমার ফেটে গিয়ে বারুদকে প্রজ্জলিত করে এবং তার বিস্ফোরণে বুলেট বেরিয়ে আসে নল দিয়ে |
ব্যারেলের ভেতরে খাঁজকাটা প্যাঁচ থাকে | এর ফলে বুলেট বেরোবার সময় নিজের অক্ষের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বেরয় ফলে বুলেটের গতিপথের ভারসাম্য বাড়ে এবং নিশানা নিখুঁত হয় | এটা না থাকলে বুলেট কেঁপে যেত এদিক সেদিক | এই কারণে অনেক রিভলবার বাজারে বেরিয়েছে লম্বা নল নিয়ে | লম্বা নল থাকার কারণে দুটো ঘটনা ঘটে | এক, বুলেট ব্যারেলের প্যাঁচকাটা খাঁজের ভেতর দিয়ে অনেকটা পথ অতিক্রম করে ফলে বুলেটের spin বেড়ে গিয়ে ভারসাম্য বাড়ে অনেক বেশি | দুই, বুলেট বারুদের জ্বলনে তৈরী গ্যাসের চাপে বেশিক্ষণ থাকে ফলে বুলেটের গতিবেগ বেড়ে যায় |
আদিম রিভলবারে হ্যামারটাকে আঙ্গুলে টেনে locking position এ নিয়ে আসতে হত গুলি করার আগে | এরপর ট্রিগার টানলে locked হ্যামারটা ধাক্কা মারত গিয়ে প্রাইমারে | আধুনিক রিভলবারে এই ঝামেলাটা নেই | এর ক্ষেত্রে ট্রিগার টানলে হ্যামার নিজেই পেছনে গিয়ে এরপর সামনের দিকে আছড়ে পড়ে প্রাইমারের ওপর |
নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে রিভলবারের ট্রিগার টানলে পর পর কি কি ঘটে বুলেট বেরোনোর আগে পর্যন্ত | একবারের ট্রিগার টানা তে একই সময়ে পর পর অনেকগুলো ঘটনা ঘটে:

- ট্রিগারের ঠেলাতে ট্রিগারের সাথে সংলগ্ন লিভারের চাপে, হ্যামারটা সরে যায় পেছন দিকে |
- যেই হ্যামারটা পেছনে সরে, এর চাপে রিভলবারের বাঁটের ভেতরে রাখা একটা spring সংকুচিত হয় (এই স্প্রিং এর রকমফের হয়) |
- যে মুহুর্তে ট্রিগার হ্যামারের দিকে এরকম ঘটনা ঘটে; ঠিক সেই মুহুর্তে অন্যদিকে ট্রিগারের সাথে যুক্ত একটা pawl (লিভারের মতই একটা জিনিস) গিয়ে খোঁচা মারে চেন্বারের সিলিন্ডারের গায়ের rachet এ | এর ফলে পরবর্তী চেম্বারটা রিভলবারের নলের সাথে এক লাইনে চলে আসে |
- চেম্বারের সাথে নলের এক লাইনে আসার ব্যাপারটা আরো নিখুঁত করার জন্য থাকে আরেকটা pawl | এই দ্বিতীয় pawl টা থাকে সিলিন্ডারের
নিচের দিকে | অপরের ঘটনাগুলো যখন ঘটতে থাকে তখনি এই pawl টা চেম্বারের তলার দিকের একটা ছোট্ট খাঁজের ভেতরে এমনিভাবে খাপে খাপে বসে যায় যে চেম্বার আর ব্যারেলের এক লাইনে থাকার ব্যাপারটা তে একচুলও হেরফের হয়না |
- এরপর যখন ট্রিগারটা পুরো পেছনে টানা হয়ে যায়, তখন রিভলবারের বাঁটের ভেতরের স্প্রিং এর ওপর থেকে চাপ মুক্ত হয়ে যায় আচমকা | সেটি তখন ছিটকে দেয় হ্যামারটাকে | স্প্রিং এর ধাক্কাতে হ্যামারটা আছড়ে পড়ে সামনের দিকে | হ্যামারের সামনের দিকে তীক্ষ্ণ firing pin সজোরে খোঁচা মারে বুলেট কার্ট্রিজের পেছনের প্রাইমারে | প্রাইমার বিস্ফোরিত হয়ে প্রজ্জলিত করে বারুদকে |
- বারুদের প্রজ্জলনে তৈরী হয় প্রচুর পরিমানে গ্যাস | এই গ্যাসের চাপে আর তাপে কার্ট্রিজটা সাময়িকভাবে ফুলে উঠে আটকে দেয় চেম্বারের পেছন দিকটা | গ্যাসের চাপ নির্গত হবার তখন একটাই রাস্তা থাকে ; নলের সামনের খোলা দিক | গ্যাসটা তখন খোলা জায়গা দিয়ে বেরোবার জন্য চাপ দেয় বুলেটের ওপর | সেই চাপে গরম বুলেট ছিটকে বেরিয়ে আসে নলের খোলা মুখ দিয়ে ঘাতক গতিবেগ নিয়ে |



শেষের কথা


এটা নিঃসন্দেহ যে আগেরদিনের পিস্তলের তুলনায় আধুনিক রিভলবার অনেক সুবিধাজনক | একবারে হয়ত ৬ টা গুলি মারা যায় ট্রিগার টেনে টেনে কিন্তু অত্যাধুনিক automatic weapon এর কাছে এ আবার কিছুইনা | কারণ আবার সেই মানুষের চাহিদা | কাহাতক আর ভালো লাগে বার বার ট্রিগার টানা ? এর থেকে ভালো হয়না যদি একবারই ট্রিগার টেনে আরো বেশি গুলি বের করা যায়? আরো বেশি প্রাণীহত্যা করা যায় আরো কম সময় ও পরিশ্রমে?!! এই আগ্রাসী চাহিদারই ফসল অত্যাধুনিক অটোম্যাটিক ওয়েপন | এই সমন্ধে জানব আমরা পড়ে আবার কোনদিন |

অত্যাধুনিক অটোম্যাটিক ওয়েপন এর সাথে এখনো পাল্লা দিয়ে রিভলবারের টিঁকে থাকার কারণ আর কিছুনা | এর সরল কারিগরী সম্ভব করেছে সবচে কম যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে সবচে কম খরচে একে অনেক বেশি কার্যকরী করে তুলতে | সাধারণ মানুষের আত্মরক্ষা হোক বা অপরাধীদের জন্যই হোক; রিভলবার এখনো সমান জনপ্রিয় |

Level 0

আমি অনুপ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 13 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 6 টি টিউন ও 144 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

অনেক কিছু জানা হল। পিলাস দিলাম।

অনুপ ভাই, অসাধারন একটা টিউন করেছেন। যাকে বলে একেবারে ক্লাস টিউন। পিস্তল, রিভলবার এই সব জন্মের পর থেকেই শুনে আসছি কিন্তু কখোনো ভালো ভাবে জানা হয়ে উঠে নি। আপনার টিউন পরে অনেক কিছু জানলাম আর অনেক ভুল ধারনা ভেঙ্গে গেলো। সবারই জানা থাকা উচিত এই সব আগ্নেয়াস্ত্রের বেসিক মেকানিজম কী।

টিউনটা সব দিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এই রকম একটা অসাধারন টিউনে মাত্র একটা কমেন্ট দুঃখজনক। এই রকম টিউন আরো চাই। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

বিঃদ্রঃ সাইলেন্সার কিভাবে কাজ করে তা জানাবেন।

ফাটাফাটি টিউন।

খুব হতাশ হলাম টিউনের কমেন্টের সংখ্যা দেখে |

হতাশ হবার কিছু নাই,ভাল জিনিস এর কদর সবাই বুঝে না ।আপনি চালিয়ে জান,অসঙ্খ ধন্যবাদ।

দারুনননননননননন টিউন। একদম প্রিয়তে রাখলাম।

Level 0

Simply awesome